সবক বদলে ফেলা কতই না সহজ
একসময় বামপন্থিদের একাংশই কেবল বলত, ভোটে কী হয়? ভোট যতই মানসম্মত হোক; তারা বলতেন, এতে তো ‘মৌলিক পরিবর্তন’ হবে না। জনগণ শুধু এক শাসকের বদলে একই শ্রেণিভুক্ত আরেক শাসক পাবে। এ কথা বলে তারা ১৯৭০ সালের ইতিহাস বদলে দেওয়া নির্বাচনও বর্জন করেছিল। এখন এ কথাটা একটু অন্যভাবে তাদের ভেতর থেকেও বলা হচ্ছে, যারা বরাবর ভোট করে এসেছে এবং নিজেদের বলে থাকে ‘ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী’। আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু করা একান্ত প্রয়োজন বলে অভিমত ব্যক্ত করলেই ফেসবুকে তাদের অনেকে এসে বলতে শুরু করেন, ‘ভালো ভোট তো অতীতে হয়েছিল। তাতে জনগণ কী পেয়েছে?’ এদের একাংশ গরিবের অবস্থা বদলাবে না বলেও বক্তব্য দিয়ে থাকে।
আগামী নির্বাচনটা সুষ্ঠু হলে তাতে কার ফল কেমন হবে, সে বিষয়ে সবারই একটা ধারণা রয়েছে। ‘ভালো ভোট দিয়েই বা কী হবে’ বলে যারা তর্ক জুড়ে দেন, তারাও জানেন পরিস্থিতিটা। সম্ভবত সে জন্যই ওইভাবে বক্তব্য দিতে তাদের বাধে না। আমরা তো দেখেছি, সুষ্ঠু নির্বাচনে কোনো ক্ষমতাসীন দলই ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারেনি। জনগণ এমন আচরণ কেন করে– সে প্রশ্ন অবশ্য তাদের করা যেতে পারে যথাযথ জরিপ চালিয়ে। দুনিয়ার সব গণতান্ত্রিক দেশেই যে ভোটাররা এমনটা করে থাকে, তা কিন্তু নয়। বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতেই এ মুহূর্তে দেশ চালাচ্ছে বিজেপি সরকার; পরপর দুই মেয়াদে। কেউ বলবে না যে, সেখানে ওই দুটি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। ভারতেও নির্বাচনে সহিংসতা, কালো টাকা, সাম্প্রদায়িকতার ব্যবহার ইত্যাদি রয়েছে। তা সত্ত্বেও নির্বাচন নিয়ে আমাদের মতো করে বিতর্ক ওখানে নেই।
আমাদের দেশে ভোট নিয়ে শুরু থেকেই সমস্যা তৈরি হয়েছে। অথচ পাকিস্তান আমলেও এ নিয়ে বড় কোনো সমস্যা ছিল না। সত্তরের নির্বাচনকে প্রভাবিত করারও চেষ্টা করতে দেখা যায়নি পাকিস্তানি প্রশাসনকে। তার ফল অবশ্য মানেনি তারা। এর ভিত্তিতে রাষ্ট্রক্ষমতায় যে পরিবর্তন আসার কথা ছিল, তা আনতে দেওয়া হয়নি। সেটা ঘিরেই তো পরিস্থিতি চলে গেল মুক্তিযুদ্ধের দিকে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৫৪ সালে যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হয়েছিল, তাতেও বিপুলভাবে জয়ী হয় ক্ষমতার বাইরে থাকা যুক্তফ্রন্ট। তারপর কী হয়েছিল, সেটা আরেক প্রসঙ্গ। কিন্তু নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছিল। তাই এ প্রশ্ন কোনোমতেই এড়ানো যাবে না যে, স্বাধীন দেশে আমরা কেন সুষ্ঠু নির্বাচনের বিধিব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হলাম? এ ক্ষেত্রে শুধু সেনাশাসকদের দায়ী করে পার পাওয়া যাবে না। নির্বাচিত সরকারের আমলেও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিধিব্যবস্থা নষ্ট করে দেওয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে।