হেনরি কিসিঞ্জার, চীনের উত্থান এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ
সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার তাঁর জীবনের ১০০ বছর পূর্ণ করলেন গত মে মাসে। এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী পত্রপত্রিকায় অনেক খবর, অনেকের পক্ষ থেকে অভিনন্দনও জ্ঞাপন করা হয়েছে। তাঁর কার্যকালের অনেক ‘সাফল্য’ও স্মরণ করা হয়েছে এ উপলক্ষে। পশ্চিমের কূটনীতি, নিরাপত্তা ও একাডেমিক জগতে তাঁকে কিংবদন্তিতুল্য জ্ঞান করা হয়। এমনকি আমাদের দেশেও অনেকের মনে তাঁর মেধা, কূটনীতিতে তাঁর দক্ষতা, সাফল্য ইত্যাদি নিয়ে গদগদ ভাব আছে। তাঁর মেধা এবং জ্ঞান হয়তো প্রশ্নাতীত। তবে তাঁর দক্ষতা বা সাফল্য কতটা, তা নিয়ে সন্দেহের সুযোগ আছে।
১৯৬৯ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে হেনরি কিসিঞ্জারের প্রভাব ছিল সর্বব্যাপী। এ সময় প্রথমে তিনি ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫—এই দুই বছর তিনি উভয় পদ অলংকৃত করেছেন। বৈশ্বিক আধিপত্য বিস্তারে প্রতিযোগী সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সহাবস্থান প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখার বাইরে, তাঁর সাফল্যের তালিকায় প্রধানত তিনটি বিষয় উঠে আসে। এক. স্নায়ুযুদ্ধকালে মার্কিন-সোভিয়েত প্রতিযোগিতায় চীনকে মার্কিন পক্ষভুক্ত করার লক্ষ্যে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা; দুই. মধ্যপ্রাচ্যে শাটল ডিপ্লোম্যাসি এবং তিন. ভিয়েতনামে প্রত্যক্ষ যুদ্ধরত মার্কিন সেনাদের প্রত্যাহারের লক্ষ্যে প্যারিস শান্তি পরিকল্পনা।
আমি মনে করি, বিগত শতাব্দীর ৬০/৭০–এর দশকে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল, পরবর্তী বিশ বছরের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন যে ভেঙে যেতে চলেছে, এ বিষয়ে কোনো ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী করতে না পারা। অথচ ইঙ্গিত যে ছিল না, তা নয়। বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তারের যে কার্যক্রম সোভিয়েত ইউনিয়ন চালাচ্ছিল, তা অর্থায়নের সক্ষমতা তাদের অর্থনীতির ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়নকে মোকাবিলার জন্য চীনের সহায়তা প্রয়োজন ছিল না যুক্তরাষ্ট্রের। বিশেষত উসুরি নদীর একটি চরের মালিকানা নিয়ে ১৯৬৯ সালের চীন-সোভিয়েত সীমান্ত সংঘাতের পর এমনিতেই চীন ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন। তাত্ত্বিক প্রশ্নেও কমিউনিস্ট দেশ দুটি ছিল বিভক্ত। এমতাবস্থায় সোভিয়েত আধিপত্য নিয়ন্ত্রণে আকাশচুম্বী ছাড় দিয়ে দরিদ্র, অনুন্নত চীনকে পাশে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল না যুক্তরাষ্ট্রের।
বিনিময়ে চীন যা পেয়েছিল, তা ছিল যুগান্তকারী। ১৯৪৮ সালের চীনা কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর চিয়াং কাই শেকের নেতৃত্বাধীন চীন প্রজাতন্ত্রের জাতীয়তাবাদী সরকার আশ্রয় নেয় তাইওয়ানে। পরবর্তী ২৩ বছর এই সরকারই জাতিসংঘে চীনের প্রতিভূ হিসেবে স্বীকৃত থাকে। মূল ভূখণ্ডের গণপ্রজাতন্ত্রী চীন থেকে যায় জাতিসংঘের বাইরে। এটি নিঃসন্দেহে একটি অন্যায্য ব্যবস্থা ছিল। চীন–মার্কিন সম্পর্ক স্থাপনের পর চীন প্রজাতন্ত্রের পরিবর্তে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন জাতিসংঘে ভেটো ক্ষমতাসহ চীনের প্রতিনিধিরূপে আবির্ভূত হয় মার্কিন সহায়তায় এবং তাইওয়ানকে চীনের অংশ হিসেবে মেনে নেয় যুক্তরাষ্ট্র।