অচিরেই বাংলাদেশ এ অঞ্চলের বড় বাণিজ্যকেন্দ্র হবে
ড. মজিবুর রহমান। বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। সম্প্রতি ভারত পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে। এর মাধ্যমে ভারত মূল ভূখণ্ড থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় তাদের পণ্য পরিবহনের সুযোগ পাবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তির সার্বিক বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন এই বিশেষজ্ঞ।
সরকার ভারতকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিল। এর বিনিময়ে বাংলাদেশ কী পাবে?
মজিবুর রহমান: অবশেষে ট্রানজিট চালু হওয়ায় আমি খুশি। দক্ষিণ এশিয়া পৃথিবীর একমাত্র অঞ্চল, যেখানে পণ্য, সেবা ও মানুষের অবাধ চলাচলের সুযোগ নেই। ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও সেই সুযোগ রয়েছে। আমাদের এ অঞ্চলেও বিমান ও নৌপথে চলাচল আছে। কিন্তু সড়ক ও রেলপথে নেই। আমরা মিয়ানমার, নেপাল, ভুটানের সঙ্গে যুক্ত নই। ভারত ও চীনের সঙ্গেও সেভাবে যুক্ত নই। আরেকটু দূরে গেলে পাকিস্তান, আফগানিস্তানেও একই অবস্থা।
এর একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে।
মজিবুর রহমান: ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ইউরোপেও আছে। সেখানকার দেশগুলোর মধ্যে হানাহানি আরও বেশি ছিল। যুদ্ধ থাকবে। এর মধ্যেও মানুষ ও পণ্য চলাচল অব্যাহত আছে। আমাদের এ অঞ্চলেও ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আগে অবাধ চলাচল ছিল। এই যোগাযোগ বন্ধের কারণে এলাকার অর্থনীতি ও মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কেউ লাভবান হয়নি। সংযুক্তি বা কানেকটিভিটি থাকলে সবাই লাভবান হবে। তবে কে কতটা বেশি লাভবান হবে, তা নির্ভর করবে সংশ্লিষ্ট দেশের দক্ষতা, পণ্য উৎপাদন ও মান রক্ষা এবং রপ্তানির সক্ষমতার ওপর। দেশের আকারের ওপর নয়।
আরেকটি বিষয় হলো এ অঞ্চলে আমি যদি বাংলাদেশকে কেন্দ্র ধরে নিই, তাহলে এর পরিধি বিশাখাপট্টনম থেকে শুরু করে নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার হয়ে চীন পর্যন্ত বিস্তৃত করতে পারি। বাংলাদেশ হলো ট্রানজিটের জন্য আদর্শ স্থান। এর আশপাশে যেসব সমুদ্রবন্দর আছে, সেগুলো বাংলাদেশের মতো নয়। আমরা যদি দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে এটি ব্যবহার করতে পারি, তবে বিরাট লাভবান হব। ইউরোপে সুইজারল্যান্ড কিন্তু এই সুবিধা নিয়েছে। ট্রানজিটের ক্ষেত্রে আমি সুইস মডেলের পক্ষে। তারা বছরে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করে ট্রানজিট দিয়ে।
এ মুহূর্তে বাংলাদেশ কতটা লাভবান হবে?
মজিবুর রহমান: চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে ট্রানজিট-সুবিধা দেওয়ায় এ মুহূর্তে ভারত বেশি লাভবান হবে। বাংলাদেশ কম লাভবান হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, মোংলা বন্দরের উন্নয়ন সেভাবে হয়নি, যেটুকু হয়েছে, তা-ও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। বন্দর উন্নয়ন করলেই হবে না, এর ব্যবহার থাকতে হবে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দরে মাঝেমধ্যে জাহাজজট হয় ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে, সক্ষমতার ঘাটতির কারণে নয়। বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা পুরোপুরি ব্যবহৃত হচ্ছে না। আমি ট্যারিফ কমিশনে থাকতেও গবেষণা করে দেখেছি, প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনা অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে জাহাজজট তৈরি হয়। প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে, ট্রানজিট থেকে ভারত বেশি লাভবান হচ্ছে, বাংলাদেশ কম লাভবান হচ্ছে। কিন্তু ট্রানজিট পুরোদমে চালু হলে বাংলাদেশ অনেক বেশি লাভবান হবে। এমনকি সিঙ্গাপুরের চেয়েও। সত্তরের দশকে সিঙ্গাপুরের কী অবস্থা ছিল, আমরা জানি। এখন সেটি পরিবহন হাব বা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশও ট্রানজিট কেন্দ্রে পরিণত হলে ব্যবসা-বাণিজ্য বহুগুণ বাড়বে। প্রশ্ন হলো আগামী বাংলাদেশকে সেই জায়গায় নিয়ে যেতে চাই কি না। আরেকটি কথা, এখন যে ট্রানজিট শুরু হয়েছে, খুবই সীমিত। কিন্তু ট্রানজিট থেকে বেশি লাভ তুলে নিতে প্রয়োজন সমন্বিত পদক্ষেপ।
আপনি ট্রানজিটে সমন্বিত পদক্ষেপের কথা বলেছেন। যে চুক্তি হয়েছে, তাতে তার প্রতিফলন আছে কি?
মজিবুর রহমান: এনবিআরের যে পরিপত্র দেখলাম, সেটা তো আংশিক। এরপর সড়ক বিভাগ, বন্দর থেকেও আলাদা পরিপত্র আসবে। নিরাপত্তার বিষয়টিও আসবে। তবে আমি বলব, এর মধ্য দিয়ে শিশুর হাঁটা শুরুমাত্র। হাঁটতে হাঁটতে একসময় শক্তভাবে দৌড়াবে। ২০১২ সালে আমি সরকারকে যে রিপোর্ট দিয়েছিলাম, সেটি আমলে নিলে বিষয়টি আরও সুন্দর হতো। আমি মনে করি, আরও প্রস্তুতি নিলে বিষয়টি ভালো হতো।
- ট্যাগ:
- মতামত
- পণ্য পরিবহন
- ট্রানজিট চুক্তি