মুদ্রাস্ফীতি শোষণের কার্যকর হাতিয়ার
প্রকাশ্যে স্বীকার করা হোক বা না হোক, পুঁজিবাদী সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য, কীভাবে, কোন ফিকিরে আপনার-আমার পকেটের টাকা ওরা এগারো জনের পকেটে নেওয়া যায়। অর্থনীতিবিদদের সাফাই হচ্ছে, এভাবে তাদের পকেটে মূলধন গঠিত হবে এবং ওই মূলধন পুনরায় বিনিয়োগ হলে কর্মসংস্থান বাড়বে। কর্মসংস্থান বাড়া মানে পণ্যের বিক্রি বাড়া এবং তার ফলে আখেরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, ইত্যাদি, ইত্যাদি। সমস্যা হচ্ছে, ওরা এগারো জনের পকেটস্থ টাকার খুব কমই বিনিয়োগ হয়, বেশিরভাগ বিদেশ পাচার হয়ে কানাডায় বেগমপাড়া, দুবাইতে মাইট্যা শেখপাড়া গড়ে ওঠে।
এই অপকর্মের খুবই কার্যকর এক অপ-হাতিয়ার মুদ্রাস্ফীতি। মুদ্রাস্ফীতি সমাজের বেশিরভাগ লোকের শ্রেফ ক্ষতিই করে। সামষ্টিক দৃষ্টিকোণ থেকে মুদ্রাস্ফীতির ফলে সঞ্চয় হ্রাস পায় এবং বিনিয়োগ কমে যায়। ব্যষ্টিক দৃষ্টিকোণ থেকে বহু কষ্টে সংসার চালাতে গিয়ে মানুষ খামোকা দুশ্চিন্তায় ভোগে, সমাজে অস্থিরতা বেড়ে যায়। এর ফলে বর্তমানে ও আখেরে কী কী ক্ষতি হয় ব্যক্তি ও সমাজের তা গবেষণার বিষয়।
কিনস সাহেব নিদান দিয়েছেন, বড়সড় কোনো যুদ্ধের পর সরকারকে যেকোনো ছুঁতায়, কোনো একটা অজুহাত বের করে ব্যয় বাড়াতে হবে, সে অবকাঠামো নির্মাণই হোক, কিংবা হোক অস্ত্রনির্মাণ। ব্যয় বাড়াতে হলে টাকা ছাপতে হবে। কতটা ব্যয় বাড়াতে হবে, কত টাকার বেশি ছাপা যাবে না? এই দুই প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু সরকারগুলো এই প্রশ্ন আদৌ করে কিনা সন্দেহ।
১৯৪৪ থেকে ১৯৪৮ এই পাঁচ বছর যুক্তরাষ্ট্র সরকার উপরোক্ত কিনসীয় নিদান মেনে চলেনি। মার্কিন সরকার তার ব্যয় ৭৫% কমিয়ে এনেছিল এবং দ্রব্যমূল্যের ওপর বেশিরভাগ নিয়ন্ত্রণ তুলে নিয়েছিল। এ ধরনের বাজেট-কর্তন ও সরকারি নিয়ন্ত্রণ কিনসের হিসাবমতো বিপজ্জনক হবার কথা ছিল, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এর ফলে মার্কিন অর্থনীতি সংকোচিত হওয়া দূরে থাকুক বরং ফুলেফেঁপে উঠেছিল।
১৯৪৪ সালের ব্রিটন উডস সম্মেলনে ডলারকে সারা পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের ‘সবেধন রিজার্ভমানি’ ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু এতে কাজ হচ্ছিল না, বিভিন্ন দেশের মুদ্রা দিনকে দিন তার মূল্য হারাচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্র স্বর্ণের যে দাম নির্ধারণ করেছিল, আউন্সপ্রতি ৩৫ ডলার, বাজারে স্বর্ণের মূল্য তার চেয়ে বাড়তে শুরু করল। ডলার থেকে শুরু করে সব মুদ্রারই দাম কমছিল, বেশি মুদ্রা ছাপানোর কারণে। মার্কিন সরকার সিদ্ধান্ত নিল, রিজার্ভে জমা থাকা কিছু স্বর্ণ তারা বাজারে বিক্রি করে দেবে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা ভেবেছিলেন, এর ফলে বাজারে স্বর্ণের সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়ে স্বর্ণের দাম কমে আসবে।
তাই করা হয়েছিল এবং কয়েক মাস পর্যন্ত স্বর্ণের দাম নিম্নমুখী ছিল বটে। ডলার শুধু নয়, ফ্রাঁ, মার্ক, ইয়েন সব মুদ্রারই দাম কিন্তু কমছিল। সুতরাং ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান ইত্যাদি দেশও চাইল, তাদের রিজার্ভ স্বর্ণ বাজারে ছেড়ে দিতে। কিন্তু তাদের স্বর্ণ তো জমা রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের ভল্টে। একাধিক দেশ ওই স্বর্ণ ফেরত চাইল। ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি শার্ল দ্য গল ১৯৬৮ সালে ফ্রান্সের গচ্ছিত স্বর্ণ ফেরত নিয়ে আসতে একটি যুদ্ধজাহাজ পাঠালেন নিউ ইয়র্কে। ফ্রান্সের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জার্মানিও তার স্বর্ণ ফেরত পেতে চাইল।