আত্মতুষ্টি নয়, বাস্তবতা অনুধাবন জরুরি
এ বছর বিশ্ব পানি দিবসের প্রতিপাদ্যে পানি ও স্যানিটেশন সংকট সমাধান ত্বরান্বিত করার কথা বলা হয়েছে। পানি ও স্যানিটেশনের গুরুত্ব বোঝার জন্য ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তখন শরণার্থী হিসেবে আমাদের প্রায় এক কোটি মানুষ প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নেয়। এমনিতেই শরণার্থী শিবিরগুলো ছিল ডোবা-নালার কাছে। জুন-জুলাই মাসের দিকে বর্ষাকালে প্রবল বর্ষণে মানুষের মল-মূত্র আর পানি একাকার হয়ে যায়। ফলে সুপেয় পানি ও স্যানিটেশনের অভাবে সেখানে কলেরার প্রাদুর্ভাব ঘটে।
শাহাদুজ্জামান ও আমার গবেষণায় এসেছে, ওই সময় কলেরায় প্রায় ৩ লাখ ১৮ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সেখান থেকে আমাদের পানি স্যানিটেশনের কার্যক্রম শুরু। ১৯৬৮ সালে ওরস্যালাইন আবিষ্কারের পর ১৯৭১ সালে শরণার্থী শিবিরে আমরা ব্যাপকভাবে এর প্রয়োগ ঘটাতে সক্ষম হই। ভারতীয় সরকার ও মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলোর সহায়তায় শরণার্থী শিবিরে টিউবওয়েল ও ল্যাট্রিন স্থাপন করা হয়। পানি ও স্যানিটেশনের গুরুত্ব বোঝানোর জন্যই প্রসঙ্গটির অবতারণা।
মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে দেশের গ্রামাঞ্চলে মাত্র ১ শতাংশ মানুষের সুপেয় পানি ও স্যানিটেশনের ব্যবস্থা ছিল। ধীরে ধীরে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আমরা ২০১০-১১ সালের দিকে ভালো অবস্থানে পৌঁছি। এমডিজির লক্ষ্যমাত্রার সময়সীমা তথা ২০১৫ সালের মধ্যে দেশের ৯৭ শতাংশ মানুষ মৌলিক পানির অধিকারের আওতায় আসে। ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের যত মানুষ যখন খোলা আকাশের নিচে মলত্যাগ করত, সেদিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল বেশ ভালো। পানিতে আর্সেনিক রোধে গভীর নলকূপ স্থাপনে আমাদের সাফল্য ছিল উল্লেখযোগ্য। বলা বাহুল্য, এ সময়ের ৯৭ শতাংশ মানুষের যে পানির কথা আমরা বলছি, সেটা যে একেবারে সুপেয় ছিল, তা নয়। এর পরও এই অর্জন নিয়ে আমাদের মধ্যে বিশেষ করে নীতিনির্ধারকরা ব্যাপক আত্মতুষ্টিতে ভোগেন।
২০১৫ সালের পর যখন এসডিজির যুগে আমরা প্রবেশ করি, স্বাভাবিকভাবেই টেকসই লক্ষ্যমাত্রায় পানির সংজ্ঞায়ও পরিবর্তন আসে। এখানে সুপেয় পানি বা পানির অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এটি নিরাপদ কিনা; তাতে রোগ-জীবাণু ও আর্সেনিক আছে কিনা; ঘরের চৌহদ্দির মধ্যে পানি আছে কিনা ইত্যাদি বিষয়ও দেখা হয়। এসডিজির সংজ্ঞা অনুযায়ী, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের আওতার মানুষের হার ৯৭ শতাংশ থেকে ৬৩ শতাংশে নেমে যায়। এই পতনের পরও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আগের মতো সেই আত্মতুষ্টিই আমরা দেখছি।
মনে রাখতে হবে, আমরা মধ্যম আয়ের দেশের দিকে যাচ্ছি; রুচিরও পরিবর্তন হয়েছে। এখন পানির মধ্যে রোগ-জীবাণু থাকলে সেটা কেউই খেতে চাইবে না। অথচ ওয়াসা কিংবা পৌরসভাগুলো যে পানি বিতরণ করে তা কতটা নিরাপদ? গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা ওয়াসার পানিতে রয়েছে ই-কোলাই নামের ব্যাকটেরিয়া। যেটা মূলত মানুষের মলের মাধ্যমে ছড়ায়। সুতরাং পানির ক্ষেত্রে আমাদের যে অর্জন, গুণগত মানের দিক থেকে তা প্রশ্নবিদ্ধ। এমনকি এ অবস্থা থেকে উত্তরণের যে ব্যবস্থা ও গতি– তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ২০১৫ সালে যেখানে ৬৩ শতাংশ মানুষের নিরাপদ পানির ব্যবস্থা ছিল, ২০২০ সালে তা বেড়ে ৬৫ শতাংশ হয়। পাঁচ বছরে ২ শতাংশ হারে যদি বাড়ে তবে শতভাগ মানুষের নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে হলে আরও কত বছর লাগবে, তা বোধগম্য।
পানি ও স্যানিটেশনে বৈষম্য একটি বড় বিষয়। যেমন ঢাকার গুলশানে বসবাসকারী মানুষ যতটা পানি ব্যবহার করে থাকে; বস্তিবাসী ততটা পারে না। সে জন্য এলাকাভিত্তিক পানির মূল্য নির্ধারণ বিষয়ে আলোচনা চলছে। সেটা ভালো হতে পারে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন সূক্ষ্ম হিসাব করেই করা উচিত।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বিশ্ব পানি দিবস
- স্যানিটেশন
- জাতিসংঘ