ভোটের বছরে নদীর জন্য করণীয়
এবার আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস উদযাপিত হচ্ছে এমন সময়ে, যখন এগিয়ে আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে অথবা পরের বছর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভোটাররা পেতে পারে সেই মহার্ঘ ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ। গতবার ভোট হয়েছিল ৩০ ডিসেম্বর। এর মাত্র সপ্তাহদুয়েক আগে ইশতেহার নিয়ে সামনে আসে বড় দল-জোটগুলো। যদিও সুযোগ ছিল তপশিল ঘোষণার আগেই ইশতেহার পেশ করার। এতে খুঁটিনাটি বিশ্লেষণে হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকে ভোটার, রাজনৈতিক বিশ্লেষক-পর্যবেক্ষক এবং সংবাদমাধ্যমের।
২০১৮ সালে সরকারে বিধায় সাফল্য ও আগামীর পরিকল্পনা নিয়ে মোটা কলেবরে ইশতেহার এনেছিল আওয়ামী লীগ; শুরুতেই ছিল ২১টি অঙ্গীকার। ক্ষমতাবঞ্চিত বিএনপি দিয়েছিল ১৯ দফা প্রতিশ্রুতি। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহার ছিল ৩৫ দফার। এই তিন ইশতেহারের আগেই জাতীয় পার্টি সামনে এনেছিল ১৮ দফার অঙ্গীকারনামা; যার নাম দলটি দিয়েছিল সৌভাগ্যের প্রতীক।
জাতীয় পার্টির ওয়াদা ছিল– ক্ষমতায় গেলে তাদের দল তিন মাসের মধ্যে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি সমূলে নির্মূল করবে। পাঁচ বছরে তরুণদের কর্মসংস্থান, শিক্ষা, কৃষি ও কৃষক, শিল্পায়নে উন্নতির আশ্বাস ছিল ঐক্যফ্রন্টের। তথ্য ও প্রযুক্তি, পরিবেশ, জ্বালানি, যুব, নারী ও শিশু নিয়ে কাজ করার কথা দিয়েছিল বিএনপি। সরকারে থাকা অবস্থায় হাতে নেওয়া প্রকল্পের ধারাবাহিকতা রাখতে আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা বলছিল শিশু, প্রতিবন্ধী, প্রবীণ কল্যাণ নিয়ে; মেগা প্রজেক্ট নিয়ে।
নদীমাতৃক একটি দেশে ভোটের মেরূকরণে নির্বাচনী ইশতেহারে ‘কী’ না থাকলেই নয়? উত্তরটি এককথায়– নদীর প্রতি ওয়াদা। রাজনৈতিক দলগুলো সে ওয়াদা দেবে। সরকারের মেয়াদ শেষে ভোটাররা দেখবে, তারা কতটুকু কথা রেখেছিল আর কতটুকু রাখেনি।
দীর্ঘদিন ক্ষমতার মুখ না দেখা জাতীয় পার্টির ২০১৮ সালের ইশতেহারে নদীর কথা মেলেনি। ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারে জলমহাল এবং হাওরের ইজারা বাতিলের কথা ছিল। ভূগর্ভস্থ পানি কম ব্যবহার করতে হয় এমন ফসল উৎপাদনের কথা ছিল। কিন্তু নদী দখল-দূষণ বন্ধের ওয়াদা ছিল না। তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন সমস্যা সমাধানের কথা ছিল। কিন্তু রাজধানীর পাশ দিয়ে বয়ে চলা বুড়িগঙ্গার কথা ছিল না।
জলমহাল এবং হাওরের ইজারা সম্পূর্ণ বাতিলের ওয়াদা বিএনপিও দিয়েছিল। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করার ওয়াদা করেছিল তারা। বিএনপি আরও বলেছিল, আন্তর্জাতিক নদী আইন অনুযায়ী বাংলাদেশে বহমান আন্তর্জাতিক নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে উদ্যোগ নেবে। যে ইশতেহার সঙ্গে করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল, তার সূচিতে উল্লেখ করা সাতটি অধ্যায়ে ‘নদী’ শব্দটি শিরোনাম হতে পারেনি। তবে পদ্মা সেতুর দুই পাড়ে শিল্পনগরী গড়ে তোলার ওয়াদা আছে। সাফল্য ও অর্জনগাথায় কেরানীগঞ্জে বুড়িগঙ্গা নদীতে টার্মিনাল নির্মাণের কথা বলেছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু ক্ষমতার চার বছরে বুড়িগঙ্গা নদী কতটুকু স্বচ্ছ জলপ্রবাহ ফিরে পেল– তা বলতে পারেনি দলটি। অবশ্য ঢাকার চারদিকের চার নদী দখল ও দূষণমুক্ত করে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার অঙ্গীকার দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল তারা।
রাজনৈতিক দলগুলোর নতুন ইশতেহার ছাপানোর দিন এসেছে। এদিকে ২০১৯ সালে হাইকোর্টের রায়ের পর দেশের নদনদীও পেয়েছে মানুষের আইনি অধিকার। তাহলে প্রতিটি নদীরও তো ভোটাধিকার আছে। যার ইশতেহার যত নদীবান্ধব, তত ভোট তার।
ঢাকার বিলুপ্ত ধোলাই নদীর দিব্যি, এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনী ইশতেহারে রাজনৈতিক দলগুলো নদীমুখী মনোভাব স্পষ্ট না করলে নদীর ভোটব্যাংক হাতছাড়া করবে তারা। রাজধানীতে বসে রাজনীতি করতে হলে ঢাকার ছয় নদনদী বংশী, তুরাগ, বালু, ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার নামে শপথ নিতে হবে। হোক সে ইউপি চেয়ারম্যান কিংবা সংসদ সদস্য; দায়িত্বভার নেওয়ার শপথ হতে হবে যাঁর যাঁর এলাকার নদীজল হাতে।
ব্রহ্মপুত্র নদের এককথা, প্রত্যেক জনপ্রতিনিধি নিজ নিজ এলাকার নদী উন্নয়নের ফিরিস্তি দেবেন তিন মাস পরপর সংবাদ সম্মেলন করে; নয়তো ভোট পাবেন না।