ইউক্রেন যুদ্ধ রূপপুরকে ঘিরে যে ভূরাজনৈতিক ঝুঁকির বার্তা দিল
এক বছর আগে রাশিয়া যখন ইউক্রেনে হামলা শুরু করে, তখন ইউক্রেনে চারটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে মোট ১৫টি নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর বা পারমাণবিক চুল্লি সক্রিয় ছিল। এসব পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ইউক্রেনের প্রায় অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতো। বর্তমানে রাশিয়ার দখলে থাকা জাপোরিঝঝিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছয়টি চুল্লি বন্ধ আছে। ইউক্রেনের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো রাশিয়ার তৈরি ভিভিইআর প্রযুক্তির এবং বেশ পুরোনো। কিছুদিন আগেও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি আসত শুধু রাশিয়ার কাছ থেকে, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির পর থেকে ইউক্রেন বিকল্প জ্বালানির উৎস অনুসন্ধান করতে বাধ্য হয়। বর্তমানে ছয়টি চুল্লির জ্বালানি মার্কিন কোম্পানি ওয়েস্টিংহাউসের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। ২০২৪ সাল থেকে আরও দুটি কেন্দ্রের জ্বালানিও ওয়েস্টিংহাউস সরবরাহ করবে বলে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। (এনার্গোঅ্যাটম বরোজ ইউএসডি৫১ মিলিয়ন টু বাই এক্সট্রা ওয়েস্টিংহাউজ ফুয়েল, ওয়ার্ল্ড নিউক্লিয়ার নিউজ, ১ জুন ২০২২)
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এমনিতেই ঝুঁকিপূর্ণ। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এ ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। এটা শুধু মিসাইল বা বোমা হামলার শিকার হওয়ার ঝুকি নয়। যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল নিশ্চিত করা, যুদ্ধের কারণে গ্রিড বিপর্যয় কিংবা অগ্নিকাণ্ডে প্রয়োজনীয় জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের জটিলতা, তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, কুলিং সিস্টেম ইত্যাদি নিরবচ্ছিন্ন রাখা, ব্যাকআপ জেনারেটরের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে পর্যাপ্ত জ্বালানির নিশ্চিত করাও এক বিরাট চ্যালেঞ্জের বিষয়।
সাধারণভাবে দেখলে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী কর্তৃক ইউক্রেনের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ধ্বংস করার জন্য সরাসরি হামলা চালানোর কথা নয়। কারণ সে ক্ষেত্রে শুধু ইউক্রেনের জনগণই নয়, নিজ দেশসহ সীমান্তবর্তী সব দেশের জন্য তা মারাত্মক ক্ষতিকর হবে। কিন্তু যুদ্ধের সময় যেভাবে বিমান হামলা ও মিসাইল আক্রমণ চলতে থাকে, তাতে ভুল করে বা কারিগরি ত্রুটির কারণে যেকোনো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও আক্রান্ত হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। পারমাণবিক স্থাপনায় সরাসরি মিসাইল হামলা ছাড়াও এ রকম পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে যে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জরুরি কর্মীরা বিদ্যুৎকেন্দ্র অঞ্চলে থাকা নিরাপদ বোধ করছেন না। ফলে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সুপারভিশন বা নজরদারিতে সমস্যা হতে পারে।
অন্যদিকে যুদ্ধের কারণে ইলেকট্রিসিটি গ্রিড বিপর্যয় ঘটলে এবং পারমাণবিক চুল্লি বন্ধ করে দিতে হলে চ্যালেঞ্জ হবে পারমাণবিক চুল্লির জ্বালানি ও জ্বালানি বর্জ্য শীতলীকরণে। সাধারণত এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য ব্যাকআপ জেনারেটর থাকে। কিন্তু ব্যাকআপ জেনারেটরের জন্য মজুত করা জ্বালানি অসীম নয়, নির্দিষ্ট সময় পর তা ফুরিয়ে যাবে। ইতিমধ্যেই ইউক্রেনের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ঘিরে এ ধরনের বহু ঘটনা ঘটেছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর উপলক্ষে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইএইএ প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে, এই এক বছরে ইউক্রেনের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর বেশ অনেকগুলোতেই রাশিয়া কর্তৃক সরাসরি গোলা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে পারমাণবিক স্থাপনার নিরাপত্তার জন্য আইএইএ নির্ধারিত যে সাতটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ রয়েছে, তার সব কটিই নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে: পারমাণবিক স্থাপনার ভৌত নিরাপত্তা; নিরাপত্তাসামগ্রীর পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ; কর্মীদের কাজের পরিবেশ; সাপ্লাই চেইন বা সরবরাহব্যবস্থা, যোগাযোগব্যবস্থা, তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ওপর নজরদারি ও জরুরি ব্যবস্থার আয়োজন এবং বিকল্প বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থা। (নিউক্লিয়ার সেফটি, সিকিউরিটি অ্যান্ড সেফগার্ডস ইন ইউক্রেন, আইএইএ, ফেব্রুয়ারি ২০২৩)