ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়
পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত্তি ছিল ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে যে আন্দোলনটির সম্মুখযাত্রার সূচনা, সেটিতে ওই জাতীয়তাবাদের প্রত্যাখ্যান ছিল কেন্দ্রীয় ঘটনা। পুরাতন জাতীয়তাবাদের প্রত্যাখ্যান কেবল নয়, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের পথ ধরে সমষ্টিগত অগ্রযাত্রার শুরুও ওখান থেকেই। প্রবল বিরোধিতা ও নির্মম দমনপীড়নের মুখে নতুন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনটি এগিয়েছে, এবং সে আন্দোলনই পরিণতিতে কৃত্রিম পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকে ভেঙে ফেলে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘটিয়েছে।
ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথমত, এটি অসাম্প্রদায়িক-ভাষা ধর্মীয় বিভাজন মানে না, সাম্প্রদায়িকতার অবরোধ ভেঙে ফেলে এগিয়ে যায়। ধর্মব্যবসায়ীরা বাংলা ভাষার ওপর নানাভাবে সাম্প্রদায়িক উৎপাত করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু ভাষা সেসব তৎপরতাকে মোটেই গ্রাহ্য করেনি, সে এগিয়ে গেছে সামনের দিকে। ভাষা শুধু যে অসাম্প্রদায়িক তা নয়, ধর্মনিরপেক্ষও বটে। ধর্মনিরপেক্ষতা অসাম্প্রদায়িকতাকেও অতিক্রম করে; কেননা তার ভেতরে থাকে পরিপূর্ণ ইহজাগতিকতা। ভাষা আত্মপ্রকাশের, সৃষ্টিশীলতার, সামাজিক যোগাযোগসহ অনেক কিছুরই মাধ্যম। ভাষার সাহায্যেই আমরা চিন্তা করি, অন্যের চিন্তাকে গ্রহণ করি, অপরের সঙ্গে দ্বন্দ্বেও লিপ্ত হই। ভাষা সমষ্টিগত স্মৃতির সৃষ্টিশীল সংরক্ষক। ভাষা ছাড়া তো মানুষ মূক ও বধির। অপরদিকে আবার ভাষা কোনো একটি শ্রেণির নিজস্ব সম্পত্তি নয়। ভাষার সৃষ্টি সমবেতভাবে, সমষ্টিগত উদ্যোগে। বিশেষ শ্রেণি, তা সে যতই ক্ষমতাবান হোক, ভাষাকে যে আটকে রাখবে সেটা সম্ভব নয়। অতীতে সম্ভব হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না।
এই যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও শ্রেণি বিভেদ না মানা, এর ভেতর রয়েছে গণতান্ত্রিকতা। গণতন্ত্র তো কেবল ভোটের ব্যাপার নয়, যদিও ভোট গণতন্ত্রকে কার্যকর করার একটি পদ্ধতি। ভোটের ভেতর দিয়ে মানুষ নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে, ক্ষমতা কার হাতে থাকবে সেটা ঠিক করে দেওয়ার অবকাশ পায়। কিন্তু ভোটের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তন ঘটবে এমন নিশ্চয়তা যে সর্বদা থাকে তা নয়। বাংলাদেশে সত্তর সালের নির্বাচনে মানুষ রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য যে রায় দিয়েছিল তখনকার ক্ষমতাধরেরা সেটা মানেনি, উল্টো পাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয় এই আতঙ্কে রায়দানকারীদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে অতি ভয়াবহ এক গণহত্যা ঘটায়। পরিণামে তারা অবশ্য ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। ইতিহাসের আঁস্তাকুড় জিনিসটা অলীক কল্পনা নয়, সেটি আছে, স্বৈরশাসকদের সেটি চূড়ান্ত সমাধিভূমি।
আঁস্তাকুড়ে কে আশ্রয় পেল কিংবা পেল না সেটা আমাদের জন্য কোনো সান্ত্বনা হতে পারে না। আমাদের জন্য সুখের বিষয় হতো যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়িত হতো। এই চেতনাটি হচ্ছে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। প্রকৃত গণতন্ত্রে অপরিহার্য শর্তের মধ্যে রয়েছে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি, চিন্তার স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের সুযোগ এবং নাগরিকদের পারস্পরিক সহনশীলতা। তবে এর মূল উপাদান হলো-সকল নাগরিকের জন্য অধিকার ও সুযোগের সাম্য। মাতৃভাষার চর্চা ওই অধিকার ও সুযোগের অংশ এবং স্মারক। মাতৃভাষা হচ্ছে সকলের অবদান, প্রত্যেকের জন্য। স্বাভাবিকভাবে বাঁচার জন্য যেমন আলো, বাতাস ও পানির দরকার, তেমনি দরকার মাতৃভাষার চর্চা।