বিজয়ের মাসে সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ
২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতির ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের অঙ্গীকার করেছিল, কিন্তু গত চার বছরে সরকার এই অঙ্গীকার পূরণকে সত্যিকার অগ্রাধিকার দেয়নি।
২০২১ সালে আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ সূচক বিশ্বকে জানান দিয়ে চলেছিল যে বাংলাদেশ একটি আত্মনির্ভরশীল এবং দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিতে পরিণত হতে চলেছে। কিন্তু ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসের শুরুতে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি বিপজ্জনক সংকটে নিমজ্জমান—তা হলো, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অভূতপূর্ব পতনের ধারা। ২০২১ সালের আগস্টে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। ওই ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে এক বছর দুই মাসের মধ্যেই রিজার্ভ ২২ বিলিয়ন ডলার কমে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের পাওনা পরিশোধের পর (আইএমএফের নির্দেশনা অনুযায়ী নতুন হিসাব পদ্ধতি অনুসরণের কারণে) ২৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। এহেন পতনের ধারা অত্যন্ত বিপজ্জনক। ইতিমধ্যে দেশের আমদানি নিয়ন্ত্রণের নানাবিধ ব্যবস্থা গৃহীত হওয়ায় গত আগস্ট মাস থেকে এলসি খোলা ক্রমান্বয়ে কমে এসেছে, কিন্তু হুন্ডি পদ্ধতিতে রেমিট্যান্স প্রেরণকে কোনোমতেই নিরুৎসাহিত করা যাচ্ছে না। হুন্ডি ব্যবসার রমরমা অবস্থা ঘটাচ্ছে আন্তব্যাংক লেনদেনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ডলারের দামের সঙ্গে কার্ব মার্কেটের ডলারের দামের পার্থক্য ৭-৮ টাকায় স্থির থাকা, যার প্রধান কারণ হুন্ডি প্রক্রিয়ায় বিদেশে পুঁজি পাচারের চাহিদার ক্রমবর্ধমান ব্যাপক উল্লম্ফন। অতএব, এই ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে কমিয়ে আনতে না পারলে এই দু-দুটি দামের পার্থক্যকে কমিয়ে আনা যাবে না। শুধু আন্তব্যাংক লেনদেনে ডলারের দামকে বাজারের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ করার জন্য ক্রমান্বয়ে পদক্ষেপ নিলে সুফল পাওয়া যাবে না। হুন্ডি-ডলারের চাহিদা এত বেশি শক্তিশালী থাকলে কার্ব মার্কেটেও ডলারের দাম ক্রমেই বাড়িয়ে পার্থক্যটা ৭-৮ টাকায় রেখে দেবে হুন্ডিওয়ালারা। সে জন্যই বলছি, হুন্ডি ডলারের চাহিদাকে দমন করতে চাইলে প্রয়োজন হবে দুর্নীতি দমনকে সত্যিকারভাবে শক্তিশালী করা, কারণ হুন্ডি ডলারের চাহিদার প্রধান অংশটা আসছে দুর্নীতিবাজ আমলা, প্রকৌশলী, সামরিক অফিসার, লুটেরা রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী এবং ব্যাংকঋণ গ্রহীতাদের কাছ থেকে।
২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার পর চাহিদা এবং সরবরাহ উভয় দিক থেকে হুন্ডির ব্যবসা অনেকখানি গুটিয়ে গিয়েছিল, যার সুফল হিসেবে বাংলাদেশ ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্সের উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জনে সমর্থ হয়েছিল। এই প্রবৃদ্ধির কারণেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত বেড়ে গিয়ে ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছিল। ২০২১ সালের দ্বিতীয়ার্ধে যখন করোনাভাইরাস মহামারির তাণ্ডব কমে আসে, তখন আবার চাঙা হয়ে ওঠে হুন্ডির ব্যবসা। ২০২২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সরকারের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) বরাত দিয়ে দেশের পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে যে শুধু হুন্ডি-প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে বর্তমানে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে আমদানির ওভারইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডারইনভয়েসিং এবং রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনার মতো মূল সমস্যাগুলো যোগ করলে দেখা যাবে প্রতিবছর এখন কমপক্ষে দেড় লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে। এর মানে, বাংলাদেশ থেকে বছরে কমপক্ষে ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার পুঁজি এখন বিদেশে পাচার হয়ে চলেছে (অথবা ডলার দেশে আসছে না), যার অর্ধেকের মতো পাচার হচ্ছে হুন্ডি-প্রক্রিয়ার বেলাগাম বিস্তারের মাধ্যমে।