আত্মবিশ্বাসহীন সমাজে মৌলবাদের উত্থান
বিশ্বজুড়ে করোনার প্রকোপ পুঁজিবাদকে কাবু করেনি, কাবু করেছে মানুষকে। পুঁজির মালিকরা এই সুযোগে ভালো মুনাফা করে নিয়েছেন। আবার করোনাকালেই তো বোঝা গেল অত্যাশ্চর্য উন্নতি ও উদ্ভাবনের ভেতরে স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা কতটা নাজুক। গরিব দেশে তো অবশ্যই, ধনী দেশেও। এবং এরই ভেতর পুঁজিবাদ-সৃষ্ট পুরাতন উৎপাতগুলো নবীন উৎসাহে খলবল করে উঠেছে। যেমন : ধর্মীয় মৌলবাদ। ইসরায়েলের উন্নতি তো চমকপ্রদই। করোনাকালে তারা গ্রহণ-সক্ষম সব নাগরিককে টিকা দিয়ে ফেলেছে। তাদের গোয়েন্দারা পৃথিবীর সর্বত্র তৎপর ও সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের অভ্যন্তরে গিয়ে অনায়াসে হানা দিচ্ছে, হত্যাকা- ঘটাচ্ছে। কিন্তু এরই মধ্যে দেখা গিয়েছে ধর্মীয় মৌলবাদী ওই রাষ্ট্রে একটি ধর্মীয় সমাবেশে ৪৪ জন মানুষ পদদলিত হয়ে মারা গেছেন, যে-ঘটনার কথা আমরা একটু আগে উল্লেখ করেছি। হামাসের রকেট হামলায় একজন নাগরিক মারা গেলে যেখানে বোমারু বিমান উড়িয়ে বিশ/ত্রিশজনকে মেরে ফেলে, তবুও শান্ত হয় না, সেখানে নিজেরাই নিজেদের ৪৪ জনকে হত্যা করে ফেলেছে। সংবাদটি যখন পাওয়া গেল তখনই অনুমান করা গেছে ফ্যাসিবাদী ওই রাষ্ট্র আরও কিছু ঘটাবে। ঘরে যে হিংস্র, বাইরে কি সে শান্ত থাকবে? ঠিক তাই! চড়াও হয়েছে গিয়ে ফিলিস্তিনিদের ওপর। উদ্দেশ্য জাতীয়তাবাদী ধর্মীয় উন্মাদনাকে জাগিয়ে তুলে সম্প্রসারণ বৃদ্ধি করা। এরই মধ্যে জেরুজালেমকে তারা নিজেদের রাজধানী ঘোষণা করেছে, সেখানে ফিলিস্তিনিদের যে ঘরবাড়ি সেগুলো ভেঙে নগরীর উন্নয়ন ঘটাচ্ছে। ফিলিস্তিনিরা বাধা দিতে গিয়েছিল। সেই প্রতিবাদকে অজুহাত করে রবার বুলেট নিক্ষেপ করে ৯ জনকে হত্যা ও ৩০০ জনকে আহত করেছে প্রথম চোটেই। প্রতিক্রিয়ায় হামাস কিছু রকেট নিক্ষেপ করেছে, যেমনটা তারা করে থাকে। আর কথা নেই, বোমারু বিমান ঢুকে গেছে। ২৫৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিল। যাদের ৬৬ জনই শিশু। ঘরবাড়ি ছেড়ে যেকোনো আশ্রয়ের খোঁজে ছোটাছুটি করছেন হাজার হাজার মানুষ। অন্যদিকে রকেটের আঘাতে ইসরায়েলে প্রাণ হারিয়েছেন দুই শিশুসহ ১২ জন। দুর্নীতির মামলায়-কাবু প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন প্রতিক্রিয়াকে কঠিন হস্তে দমন করা হবে। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আরব রাষ্ট্রগুলো দাঁড়াবে বলে এতকাল আশা করা হতো; সে-আশা এখন মরে গেছে; অনেক কটি রাষ্ট্র এরই মধ্যে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে ফেলেছে, অন্যরাও আগ্রহী। তাদের সবার হয়ে সৌদি আরবের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘এতে সুবিধা হবে’। অবশ্যই হবে। তবে নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের নয়, পীড়নকারী ইসরায়েলেরই। আর হবে ওই মুসলিম স্বৈরশাসকদের।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের যে লড়াই এটি আদতেই কোনো ধর্মযুদ্ধ নয়; এটি হচ্ছে দখলদারদের বিরুদ্ধে উৎপাটিতদের প্রতিরোধ। ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় উপেনের জমি যে দখল করে নেয় ধর্মপরিচয়ে সে ব্যক্তিও উপেনের মতোই একজন হিন্দু ছিল, কিন্তু দখলদার হিসেবে ব্যক্তিটির ধর্মীয় পরিচয় নয় জমিদার পরিচয়টিই ছিল একমাত্র সত্য। ফিলিস্তিনিরা মার খাচ্ছেন মুসলমান হিসেবে নয়, দুর্বল জনগোষ্ঠী হিসেবেই। এটি ধর্মযুদ্ধ হলে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান রাজা-বাদশাহ ও শাসকদের ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা ছিল। সেটা তারা করেনি। সাড়াই দিচ্ছে না। প্রতিরোধ সংগ্রামে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে নিরন্তর যিনি লিখেছেন ও বক্তৃতা করেছেন, বিশ্ববাসীকে সমস্যাটির বিষয়ে জানিয়েছেন, তিনি হচ্ছেন এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ (১৯৩৫-২০০৩); ধর্মপরিচয়ে তিনি ছিলেন খ্রিস্টান। আর সশস্ত্র প্রতিরোধে নেতৃত্ব দিয়েছেন যারা তাদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্ধর্ষ ছিল যে পপুলার ফ্রন্ট তার নেতা জর্জ হাবাশ’ও (১৯২৬-২০০৮) মুসলমান ছিলেন না, ছিলেন খ্রিস্টানই। জর্জ হাবাশের নেতৃত্বাধীন পপুলার ফ্রন্ট যুদ্ধটাকে সমরবাদে সীমিত রাখেনি, নিয়ে গিয়েছিল মনস্তাত্ত্বিক স্তরেও। তার পরিকল্পনায় বিমান হাইজ্যাকের অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর সব ঘটনা ঘটেছে; ইউরোপে ইসরায়েলি বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান ও দূতাবাসে হামলা হয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকা বুঝে নিয়েছে যে ফিলিস্তিনিদের ক্ষতটা অত্যন্ত গভীর, মনের জোরও কেমন প্রচ-। তাদের ধমকে বা প্রবোধে নিবৃত্ত করা যাবে না। জর্জ হাবাশ ‘অসলো চুক্তি’র দুই-রাষ্ট্র নীতি মানতেন না। তার সংগঠনের বক্তব্য ছিল রাষ্ট্র হবে একটাই, আর তার চরিত্র হবে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক; সে-রাষ্ট্রে ইহুদি, মুসলমান, খ্রিস্টানে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না, সবারই থাকবে সমানাধিকার। ১৯৬৯ সালে নিজেদের সংগঠনটিকে তারা একটি মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টিতে রূপান্তরিত করেন।