মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক অবস্থান
মওলানা ভাসানীকে বলা হয় কৃষকনেতা। এক অর্থে সেটা তিনি ছিলেন বৈকি। কিন্তু কেবল কৃষকের নয়, নেতা ছিলেন তিনি মৎস্যজীবী, বিড়িশ্রমিক, কারখানার শ্রমিক, চা-শ্রমিক, রিকশাশ্রমিক, পাটচাষিসহ সব মেহনতি মানুষের। তাঁদের মুক্তির জন্য তিনি লড়াই করেছেন।
রাজনীতিতে মওলানার রাজনৈতিক অবস্থান পেটি বুর্জোয়াদের পক্ষে ছিল অসহ্য, কারণ তিনি যেটা চাইছিলেন, সেটি হলো সামাজিক বিপ্লব, যদিও ওই বিপ্লবের কথা পরিষ্কারভাবে তিনি বলতে পারেননি। বিপ্লবের অত্যাবশ্যকতার ধারণায় পৌঁছাতেও তাঁর সময় লেগেছে। স্থিরভাবে রাজনৈতিক সাহিত্য অধ্যয়ন করার ও লেখার কাজে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ তিনি পাননি। তদুপরি তিনি ছিলেন মাদ্রাসায় শিক্ষিত এবং প্রথম জীবনে লোকে তাঁকে মানত একজন পীর হিসেবে, তিনি তাদের বিশ্বাসকে আঘাত করতেন না, যদিও জানতেন যে তাঁর পানিপড়া ও ঝাড়ফুঁকে কোনো কাজ হবে না। পরামর্শ দিতেন ডাক্তারের পরামর্শ নিতে, টাকা গুঁজে দিতেন হাতে, প্রয়োজন দেখলে। সে জন্য তাঁর পক্ষে ও সঙ্গে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের কাছেও মনে হয়েছে সমাজ পরিবর্তনের বিষয়ে তাঁর চিন্তা ছিল অত্যন্ত অস্পষ্ট। যেমনটা তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বদরুদ্দীন উমর বলেছেন তাঁর ‘পলিটিকস অ্যান্ড সোসাইটি ইন ইস্ট পাকিস্তান অ্যান্ড বাংলাদেশ’ বইয়ে। তা ছাড়া, তাঁর বক্তব্য প্রচারের জন্য পত্রপত্রিকাও ছিল না। ইত্তেফাকের মালিকানা বদল হয়েছিল।
অন্য পত্রিকার সবগুলোই ছিল হয় সরকার-সমর্থক, নয়তো টাকাওয়ালাদের মালিকানার; তারা সবই মওলানার প্রতি বিরূপ ছিল। মওলানার মধ্যে দোদুল্যমানতা ছিল না; তবে একধরনের অস্থিরতা ছিল বলে তাঁর অনুসারীদের কেউ কেউ মনে করেন। সেটা যে অসত্য, তা-ও নয়। যে জন্য দেখা যেত তিনি আচমকা কোনো কোনো সিদ্ধান্ত দিয়ে ফেলছেন, অন্যদের না জানিয়ে। যেন পেটি বুর্জোয়া তৎপরতা। কিন্তু পরে যা প্রমাণিত হয়েছে তা হলো, তাঁর সিদ্ধান্তগুলোর কোনোটাই ভ্রান্ত ছিল না। তাঁর ধীশক্তি ছিল অসাধারণ; তিনি টের পেতেন মানুষ কী চায়, তারা কত দূর যেতে প্রস্তুত এবং প্রতিপক্ষের সবলতা কোথায়, কোথায় দুর্বলতা। কখনো কখনো মনে হতো তিনি তাঁর মতকে জোর করে চাপিয়ে দিচ্ছেন। আসলে তিনি যা করতেন তা হলো, পাছে বিলম্ব ঘটে তাই সিদ্ধান্তগুলো দ্রুত নেওয়া এবং তাঁর জন্য খুব বড় রকমের অসুবিধা ছিল এই যে তাঁর রাজনৈতিক সংগঠন সুসংগঠিত ছিল না। সংগঠনের ভেতরে বিভিন্ন মত কাজ করত; কোনো অংশ ছিল ভ্রান্ত আবার কোনো অংশ প্রতিক্রিয়াশীল।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে তিনি মুসলিম লীগে ছিলেন, কিন্তু পাকিস্তান যখন প্রতিষ্ঠা পেল, তখন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি টের পেলেন যে এই পাকিস্তান মানুষকে মুক্তি দেবে না; এখানে পুরোনো শাসন-শোষণই আবার নতুন চেহারায় বহাল থাকবে; তাই দ্রুতই তিনি মুসলিম লীগ ছেড়ে দিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগের গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হলেন এবং তাঁর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে তো বটেই, প্রধানত তাঁর চেষ্টাতেই আওয়ামী মুসলিম লীগ একটি শক্তিশালী গণসংগঠন হয়ে উঠল। সংগঠনের অসাম্প্রদায়িকীকরণও তাঁর আগ্রহেই ঘটল। কিন্তু আওয়ামী লীগ যখন সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে সক্ষম হলো, তখন স্বায়ত্তশাসন ও পররাষ্ট্রনীতি—এই দুই মৌলিক প্রশ্নে দলের প্রতিক্রিয়াশীল অংশ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন অবস্থানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে চলে যেতে চাইল। ফলে দল দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। এরপর প্রগতিশীল অংশটি পশ্চিম পাকিস্তানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের সঙ্গে একত্র হয়ে ন্যাপ গঠন করে।