খেলা হবে, নূর হোসেন কোথায়?
সম্প্রতি খেলা হবে বলে একটি রব উঠেছে। সরকারি দল বলছে খেলা হবে, বিরোধী দলও বলছে খেলা হবে। একদা দুই দল মিলেই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে খেলেছিল। খেলে স্বৈরাচারকে পরাজিতও করেছিল। সেই খেলায় জীবন দিয়েছিল তরুণ নূর হোসেন। তাঁর শরীরের রক্ত দিয়েই লিখে গিয়েছেন ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। এই যে দল দুটি বলছে খেলা হবে, এর অর্থ কী?
খেলা হবে, শক্তি প্রদর্শন হবে, মানুষের ভোগান্তি হবে, দুই দলই ক্ষতবিক্ষত হবে। গণতন্ত্রের প্রতিভূ সংসদ অকার্যকর থাকবে। আর স্বৈরাচার নিপাত না হয়ে দলটি গৃহপালিত বিরোধী দল হয়ে সংসদে বহুদিন ধরে অবস্থান করছে। সেই দলেই থেকে থেকে খেলা চলছে। মূলত এই ‘খেলা হবে’ রবটি উঠেছে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে। কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন বিজেপির বিরুদ্ধে বাংলাকে স্বশাসিত করার জন্য নির্বাচনী প্রচারণার একটা আওয়াজ। সেখানে খেলা শেষ হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যের কর্তৃত্ব রক্ষা করতে পেরেছে। যে স্লোগানটি রাজ্যের বিষয়, তাকে বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্রের মধ্যে টেনে আনা কি সুবিবেচনার কাজ?
ওখানে খেলা হলে রাজ্য, রাষ্ট্র এবং আন্তরাজ্য সমীকরণে জনগণ স্বস্তি পায়। কিন্তু এখানে? সবকিছুর ওপর প্রভাব পড়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর চাপ পড়ে, যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধিতে। এই পরিস্থিতির সম্পূর্ণ সুযোগ নেন ব্যবসায়ীরা। এই স্বাধীন ব্যবসায়ীদের ওপর কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সহিষ্ণু জনগণের নেই, সরকারের নেই, এমনকি তাঁদের সর্বোচ্চ সংগঠন এফবিসিসিআইয়েরও নেই।
আরও বড় বিষয় হচ্ছে দুর্নীতি। একচেটিয়া ক্ষমতা সব সময়ই দুর্নীতি ডেকে আনে। সরকারি অফিস-আদালতে ঘুষ নেওয়া একটা প্রকাশ্য বিষয়। ন্যায্য কোনো কিছু হওয়ার উপায় নেই। টাকা দিতেই হবে। খেলায় অংশগ্রহণকারী দুটি দল কি দুর্নীতির বিষয়ে কিছু বলছে? বিরোধী দলের একটাই কথা, রাষ্ট্রক্ষমতায় যাবে। গিয়ে কী করবে? সর্বব্যাপী দুর্নীতি কি রোধ করতে পারবে? তার জন্য কি কোনো রোডম্যাপ আছে? বললে বিপদও আছে। কর্মীরা মাঠ থেকে চলে যাবে। দুই দলের মধ্যে একই সংকট। তাহলে খেলাটা কি টাকার?
নূর হোসেন আজকের দিনে প্রাণ দিয়েছিলেন একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য। একধরনের গণতন্ত্র এসেও ছিল, কিন্তু আবারও তার মীমাংসা করতে হচ্ছে রাজপথে। এত রক্তের বিনিময়ে লাল-সবুজের পতাকাশোভিত সংসদটা মীমাংসার ক্ষেত্র হতে পারল না। যেসব দেশে গণতন্ত্র আছে, সেখানে সংসদই কুরুক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায় (অবশ্য ট্রাম্প যেভাবে সংসদ আক্রমণ করে ফেললেন, তা একটা বড় ঘটনা), বিচার বিভাগ শক্ত হাতে আইনের প্রতিষ্ঠা করে এবং সর্বোপরি জননিরাপত্তার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। সরকার ক্রমেই গৌণ হয়ে দাঁড়ায় গণজীবনে। কিন্তু যেখানে গণতন্ত্রচর্চা অনুপস্থিত থাকে, সেখানে খেলাই চলে। খেলার শেষ হয় না; বরং নতুন নতুন খেলার জন্ম নেয়। রাজপথ থেকে গড়িয়ে যায় রাজনৈতিক দলের সংগঠন, তারপর যেকোনো সংগঠনের কর্মকাণ্ডে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সরকারি-বেসরকারি অফিসে এবং সবশেষে পরিবারে। খেলার শিষ্টাচার আর থাকে না।
- ট্যাগ:
- মতামত
- শহীদ নুর হোসেন দিবস