মিডিয়ার মাস্তানি, অজ্ঞতা ও কয়েকটি বেগুন
একাত্তর জার্নালের টকশোর আলোচনা নিয়ে প্রতিক্রিয়ার ফলে কৌতূহলবশত ড. এইচ এম জাকিরসহ সাতজনের গবেষণাপত্রটি পড়ার সুযোগ হলো। এনিয়ে বিতর্ক না হলে হয়তো কখনোই পড়া হতো না। এটি প্রকাশিত হয়েছে বিখ্যাত Nature পত্রিকার অঙ্গীভূত উন্মুক্ত তথ্য জার্নাল (open source journal) হিসেবে পরিচিত Scientific Reports-এ। বিজ্ঞান সম্পর্কে সামান্য খোঁজখবর জানা পাঠকের কাছে সায়েন্টিফিক আমেরিকান, নেচার এবং সায়েন্স– এই তিনটি পত্রিকা অপরিচিত হওয়ার কথা নয়। আমি এক সময় উৎসাহ নিয়ে এই তিনটি পত্রিকা কেবল পড়িইনি, বাংলাবাজার পত্রিকার বিজ্ঞানবিষয়ক বিভাগটি আমার তত্ত্বাবধানে থাকার কারণে সেখান থেকে বহু লেখা অনুবাদ করে ছাপিয়েছি এই পত্রিকাগুলো থেকে। নিজেও কখনো কখনো সেগুলোর কোনো লেখা অনুবাদ করেছি। যারা বিজ্ঞানের ছাত্র ও শিক্ষক, তাদের কাছে শুনেছি, তিনটি পত্রিকাই বিশ্বসেরা বিজ্ঞান সাময়িকীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত ও আলোচিত। নিশ্চয়ই আরও কিছু পত্রিকাও আছে। আমাদের পত্রিকাজগতের অনেক কর্মীও নিশ্চয়ই এই পত্রিকাগুলোর সাথে পরিচিত। সুতরাং, নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে এগুলোর কোনো একটিতে গবেষণা প্রকাশিত হওয়া মানে সত্যি খুব বিরাট ব্যাপার, খুবই সম্মানের।
ড. জাকিরদের গবেষণাটি সরাসরি ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত না হলেও, তারই অঙ্গীভূত Scientific Reports-এ প্রকাশিত হওয়ায় গবেষণাপত্রটির মহিমা একবিন্দুও কমে যায় না। আমি সত্যিই গর্বিত বোধ করি যে, আমাদের মতো বিজ্ঞান ও গবেষণার আকালের দেশে একদল গবেষকের লেখা ওরকম একটি উঁচুমানের পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এই দেশে যখন মানবদেহে আরবি অক্ষর ও কালাম আবিষ্কারের মতো বিজ্ঞানের নামে অবৈজ্ঞানিক গবেষণা (গবেষণাটিও অন্য কোনো বিদেশি অখ্যাদ্য এক জার্নাল থেকে চুরি করা) করা হয়, সেখানে এরকম একটি গবেষণা প্রকাশের কারণে গৌরববোধ করা এবং গবেষকদেরকে সাধুবাদ জানানো উচিত ছিল আমাদের। কিন্তু আমার করেছি ঠিক উল্টো, যেমনটা করে থাকে ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো তাদের বিজ্ঞানবিমুখতার কারণে। মৌলবাদীদেরকে চিনতে অসুবিধা হয় না এবং বুঝতেও অসুবিধা হয় না কেন তারা সেটা করে। তারা তাদের কাজে স্পষ্ট। তারা প্রগতিশীলতার আল্লাখেল্লা পরে নেই। কিন্তু যারা তা পরে আছে এবং মৌলবাদীদের মতোই অভিন্ন আচরণ করছে বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিয়ে, তখন কিন্তু সত্যিই সেটা ভয়ের বিষয়।
আপনি যাদেরকে বিজ্ঞানমনস্ক ভাবছেন তারা তা নয়। এই অর্থে, মিথিলা ফারজানার সঞ্চালনায় একাত্তরের জার্নালের টকশোটি আমাদেরকে কেবল হতাশই করেনি, পাশাপাশি বহু ভীতিকর প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়। এক, একাত্তর টিভিতে এই অনুষ্ঠানটি কীভাবে হতে পারল যেখানে এই গবেষণাকে তিরস্কৃত করা হয়েছে? একাত্তরের চেতনা থেকেই যদি এই টিভির জন্ম হয়ে থাকে তাহলে তাদের এই কাজটি কি ওই চেতনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়েছে? দুই, বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে এভাবে তিরস্কৃত ও অবমূল্যায়ন করা মানে এ ধরনের কাজকে নিরুৎসাহিত করা। ডিজিটাল এই সরকার কি তাদের এই বিজ্ঞানবিদ্বেষী মনোভাবের সাথে একমত? তিন, তাদের এই আচরণ মূলত ধর্মীয় সেই সব মৌলবাদীদেরকে উৎসাহিত করবে এবং বৈধতা দেবে যারা হামেশাই বিজ্ঞানবিরোধী বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি এক ভিডিওতে দেখলাম মুফতি কাজী ইব্রাহিম বলছেন, “আইস্টাইন একটা চোর , নিউটন একটা চোর, গ্যালিলিও তো আরও বড় চোর।” মানবজাতির সর্বকালের সেরা তিন বিজ্ঞানী সম্পর্কে এই অসম্মানজনক উক্তি– এটাই এখন আমাদের সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু বিষয়টি কেবল সাংস্কৃতিক আদর্শের জায়গাতেই সীমাবদ্ধ নয়, আরও কতগুলো প্রশ্নের মুখোমুখি আমাদেরকে দাঁড় করিয়ে দেয়।