মোংলা বন্দর ড্রেজিং প্রকল্পের আওতায় পশুর নদ খনন করা হচ্ছে। স্বীকার করি, নাব্যর জন্য নদনদী খনন প্রয়োজন। কিন্তু খননের পর বালু ফেলার জন্য উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করাও জরুরি। কারণ নদনদীর উপকার করতে গিয়ে ভূমির ক্ষতি করা যাবে না। দুর্ভাগ্যজনক, পশুর নদ খনন করে সেই বালু ফেলার চেষ্টা চলছে খুলনার দাকোপ উপজেলার বানিশান্তা এলাকার কৃষিজমিতে। তার মানে, নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনতে গিয়ে ফসলি জমির সর্বনাশের পাঁয়তারা চলছে। বিকল্প অনেক জায়গা থাকার পরও সেখানকার ৩শ একর ফসলি জমিতেই বালু ফেলতে হবে কেন- বিষয়টি বোধগম্য নয়। এর নেপথ্যে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ নেই তো?
আমরা জানি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিক উপলক্ষে কৃষিজমি রক্ষার তাগিদ দিয়ে এসেছেন। বিশেষত করোনা অতিমারির পর প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন, আবাদযোগ্য সব জমিতে কৃষিকাজ করতে হবে। কিন্তু পশুর নদ খননের ক্ষেত্রে মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ তা স্পষ্টত উপেক্ষা করছে। এটাও মনে রাখতে হবে, ফসলি জমি কমে যাওয়ার কারণে গোটা বিশ্বেই খাদ্য উৎপাদনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বাংলাদেশেও আবাসিক ও বাণিজ্যিক, এমনকি অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্যও কৃষিজমিতে হাত পড়ছে। এ ছাড়া করোনা অতিমারির কারণে মহামারি করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে যখন খাদ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, তখন জেনেশুনে কৃষিজমি নষ্ট করা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
আমরা দেখেছি, বানিশান্তা এলাকার ফসলি জমিতে আবাদ করে তিন পুরুষ জীবিকা নির্বাহ করছে। এই জমি হঠাৎ আবাদযোগ্য হয়নি। বহু কষ্ট করে লবণাক্ত জলাশয়ের পাশের এসব জমিতে উর্বরতা এনেছে কৃষকরা। এখন এ জমিতে বালু ফেলা হলে দুই-তিন বছর আবাদ করতে না পারলে কৃষকরা খাবে কী? তাদের এতদিনের খাটাখাটি সব বৃথা যাবে।
এই পরিস্থিতির আর্থসামাজিক প্রেক্ষিতও গুরুত্বপূর্ণ। বানিশান্তার বেশিরভাগ বাসিন্দা হিন্দু সম্প্রদায়ের। তারা 'দুর্বল' জনগোষ্ঠী বলেই কি তাদের আয়ের একমাত্র উৎসে এভাবে আঘাত করা হচ্ছে? কোনো চক্র কি চাইছে- ওই এলাকার হিন্দুরা উদ্বাস্তু হয়ে যাক? এ ধরনের পাঁয়তারা শুধু বানিশান্তা নয়; দেশের জন্যও ভালো হবে না। আশার কথা, বানিশান্তা এলাকার সংসদ সদস্য ও সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য উভয়েই কৃষিজমিতে বালু ফেলার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মতামত উপেক্ষা করেই বন্দর কর্তৃপক্ষ বালু ফেলতে অনড় অবস্থান নিয়েছে। আমরা শুনেছি, আন্দোলনরত এলাকাবাসীকে হুমকি-ধমকিও দেওয়া হচ্ছে। যদি এ অভিযোগ সত্য হয়, তাহলে হুমকিদাতাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। একদিকে কৃষকের পেটে লাথি মারার পাঁয়তারা চলছে, অন্যদিকে প্রতিবাদ করতে গিয়ে হুমকির মুখেও পড়তে হচ্ছে তাদের।
পরিস্থিতি দেখেশুনে মনে হয়, বন্দর কর্তৃপক্ষ ওই এলাকাকে জমিদারি ভেবেছে। আমরা স্পষ্ট বলতে চাই- রাষ্ট্রের যেসব কর্মচারী নিজেদের এভাবে 'রাজা' এবং নাগরিকদের 'প্রজা' মনে করে, তাদের অবিলম্বে অপসারণ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ উপেক্ষা, জনগণকে হুমকি ও কৃষিজমি ধ্বংসের পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত থেকে মোংলা বন্দরের চেয়ারম্যান স্বপদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন বলে আমি মনে করি।
এটাও মনে রাখতে হবে- উন্নয়ন আর অবকাঠামো এক নয়। উন্নয়নের মৌলিক ও প্রথম শর্ত হচ্ছে- জনগণ খাবার পাচ্ছে কিনা, তারা ভালো আছে কিনা। আগে জনগণের স্বার্থ দেখতে হবে। জনগণের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে- এ রকম কোনো কাজ করে উন্নয়ন করা যাবে না।
- ট্যাগ:
- মতামত
- নদী খনন
- হুমকির মুখে কৃষি