অসংগঠিত কৃষক শক্তিহীন
বাংলাদেশের কৃষকরা বীজ-সার-পানিপ্রযুক্তি চালু হওয়ার পর চাষবাসের সনাতনি পদ্ধতি ত্যাগ করে ভিন্ন ধরনের চাষাবাদে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। এ কথা সত্য, কৃষক সবাই মিলে হঠাৎ করে এই প্রযুক্তিতে অভ্যস্ত হননি। রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ কৃষকদের নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করার জন্য ধীরে ধীরে অভ্যস্ত করে তুলেছিল। সনাতনি কৃষি ব্যবস্থায় কৃষক জমিতে উৎপাদিত শস্যের মধ্য থেকে বীজ রেখে দিতেন। জমিতে সার হিসেবে সবুজ সার ব্যবহূত হতো। সবুজ সারের প্রধান উপাদান ছিল গোবর। ক্ষেত্রবিশেষে জমিতে সেচ দেওয়া হতো। সেচের পানি প্রধানত আসত ভূ-উপরিস্থ পানি থেকে। সেচের জন্য দোন অথবা সেঁউতি ব্যবহার করা হতো। চাষ দিয়ে জমি প্রস্তুত করার জন্য ব্যবহূত হতো হাল; যেটি লাঙল-জোয়াল এবং একজোড়া বলদ দিয়ে তৈরি হতো। চাষের কাজ শেষ হওয়ার পর মই দিয়ে চাষের জমি সমান করা হতো। কৃষকরা এখন রোয়া রোপণের প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। এর আগে ক্ষুদ্র একখণ্ড জমিতে পানিতে ভালো করে ভিজিয়ে কাদামাটির সৃষ্টি করে তাতে ঘন করে বীজ ছিটিয়ে বীজতলা প্রস্তুত করা হয়। বীজতলার চারাগুলো ৬ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যে পৌঁছালে সেগুলো তুলে শস্যক্ষেতে রোপণ করা হয়। রোপণের প্রচলন অনেক গুণ বেড়ে গেছে বীজ-সার-পানিপ্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে। কৃষিতে প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে তিনগুণ শস্য উৎপাদন সম্ভব হয়েছে।
এর ফলে বাজারের ওপর কৃষকের নির্ভরশীলতা অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজার থেকে যেসব পণ্যসামগ্রী কিনে কৃষিতে ব্যবহার করা হয় এর মধ্যে আছে সেচযন্ত্র চালানোর জন্য বিদ্যুৎ, সার হিসেবে ব্যবহারের জন্য রাসায়নিক সার এবং পোকামাকড় দমনের জন্য রাসায়নিক কীটনাশক। এ ছাড়া শ্রমবাজার থেকে কৃষিমজুর ভাড়া করা এবং জমির বাজার থেকে বর্গাপ্রথা অথবা লিজের মাধ্যমে জমি সংগ্রহ করা। জমি চাষ করার জন্য হালের ব্যবহার ধীরে ধীরে কমে গেছে। কারণ হাল চালানোর জন্য একজোড়া বলদ সংগ্রহ করা ক্রমান্বয়ে ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছিল। চাষের বলদের জায়গায় এলো পাওয়ার টিলার অথবা ট্রাক্টর। পাওয়ার টিলার দিয়ে চাষ করার ফলে মাটির গভীরে বেশি করে খনন করা সম্ভব হয়। এই কাজটিকে যদি চাষ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় তাহলে দেখা যাবে, পাওয়ার টিলার অথবা ট্রাক্টর সনাতন লাঙলের তুলনায় অনেক বেশি দক্ষ। বাংলাদেশের কৃষকরা ক্রমান্বয়ে যান্ত্রিক চাষাবাদের দিকে ঝুঁকছেন। নতুন প্রযুক্তি তাঁরা গ্রহণ করছেন ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য। কিন্তু বাজার ব্যবস্থা যদি ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে, তাহলে অনেক কৃষকের পক্ষে চাষাবাদ অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না।
সম্প্রতি ডিজেল ও সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ বেড়ে গেছে। ক্ষেত প্রস্তুত থেকে শুরু করে সেচ দেওয়া, মাড়াই করা, সার ছিটানো, শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ করা এবং ফসল ঘরে তোলা সব ক্ষেত্রেই বাড়তি ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হচ্ছে কৃষককে। কয়েক দিনের মধ্যে ইউরিয়া সার ও ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে আমনের ভরা মৌসুমে হিমশিম খাচ্ছেন কৃষক। কৃষিতে উৎপাদন ভালোমন্দ হওয়া নির্ভর করে অনেকাংশে প্রকৃতির ওপর। এ কারণে কৃষি একটি ঝুঁকিপূর্ণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। বন্যা, খরা, শিলাবৃষ্টি এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ কৃষিকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। এ বছর শ্রাবণ মাসে খুবই কম বৃষ্টিপাত হওয়ায় ধান চাষের জন্য নির্ভর করতে হচ্ছে সেচের ওপর। লোলিফট পাম্প, শ্যালো টিউবওয়েল এবং গভীর নলকূপ ব্যবহার করা হয় সেচের জন্য। এই সেচযন্ত্রগুলো চালাতে প্রয়োজন ডিজেল। ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি বেড়েছে ৩৪ টাকা এবং ইউরিয়া সারের দাম বেড়েছে প্রতি কেজিতে ৬ টাকা। এ সময়ে কম বৃষ্টিপাত ও ডিজেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। কৃষকরা আশঙ্কিত তাঁরা তাঁদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম পাবেন কিনা?