অসাম্প্রদায়িক চেতনার শক্তি হ্রাস নিয়ে উদ্বেগ
জাতি’ হিসেবে ভারতের টিকে থাকার বিষয়ে উদ্বেগ ও আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। ৩০ জুন কলকাতায় অমর্ত্য সেন গবেষণা কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে তিনি তাঁর এ আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেন। বহু মত ও বহু ধর্মের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয় জাতীয়তা সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রীয় সমর্থন, পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রশ্রয়ে ক্রমেই হিন্দুত্ববাদী উগ্রতায় রূপ নিচ্ছে দেখেই বস্তুত তিনি এ মন্তব্য করেছেন। তাঁর এ মন্তব্য শুধু সময়োচিতই নয়, ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতির এ সময়কার দুর্ভাগ্যজনক ও হতাশাব্যঞ্জক প্রবণতার বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদও বটে। বিশ্বের অগ্রসর চিন্তার সব মানুষ নিঃসন্দেহে তাঁর এ প্রতিবাদকে সাধুবাদ জানাবেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ১৯৪৭ সালে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি লাভের পর পরবর্তী প্রায় ছয় দশক ধরে ভারতের সাধারণ মানুষ তাদের অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বজায় রাখতে সক্ষম হলেও (নির্বাচনের ফলাফলকে ভিত্তি ধরে বলা) ২০১৪ সালের নির্বাচনে এসে তা এমন ব্যাপক পরিসরে পাল্টে গেল কেমন করে? এটি কি সত্যি কোনো আকস্মিক পরিবর্তন নাকি পূর্ববর্তী বছরগুলোতে ভেতরে-ভেতরে এই পরিবর্তনের ক্ষেত্র ক্রমেই তৈরিই হচ্ছিল, নাকি ভিন্নতর কোনো ব্যাখ্যাও এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? উল্লেখ্য, ১৯৮৪ সালে ভারতের ৫৪৩ সদস্যবিশিষ্ট লোকসভায় হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) আসনসংখ্যা ছিল ২টি। আর সেখান থেকে মাত্র ৩০ বছরের ব্যবধানে ২০১৪ সালে এসে তা উন্নীত হয়েছে ২৮২টিতে এবং দেশটির সমাজ ও রাজনীতির সাম্প্রতিক গতিবিধি অনুযায়ী ২০২৩ সালের আসন্ন নির্বাচনে তা যদি ৩০০ ছাড়িয়ে যায়, তাতে মোটেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আর তাতে করে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ যে ক্রমান্বয়ে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদে রূপান্তরের পথে হাঁটবে, সে আশঙ্কাই প্রবল এবং সহজেই অনুমেয় যে বস্তুত সেই আশঙ্কার কথা ভেবেই অমর্ত্য সেনের উপরিউক্ত উদ্বেগ।
১৯৪৭-পূর্ব ব্রিটিশবিরোধী সর্বভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়েই ছিল বুর্জোয়া পুঁজিবাদী দল। এর মধ্যে মুসলিম লীগ যেমন ছিল ডানপন্থী, তেমনি কংগ্রেস ছিল কিঞ্চিৎ পরিমাণে হলেও বামপন্থার প্রতি সহানুভূতিশীল, অন্তত জওহরলাল নেহরুর জীবদ্দশা পর্যন্ত। এ অবস্থায় কংগ্রেস যত দিন ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় (কেন্দ্রে) ছিল, তত দিন পর্যন্ত কাগজে-কলমে হলেও সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বহাল ছিল। তদুপরি ১৯৪৭-পূর্ব ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকালে গড়ে ওঠা কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শিক প্রভাব সে সময় যেভাবে সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল, সেটিও স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ধর্মনিরপেক্ষ ভাবধারা টিকিয়ে রাখতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল বলে ধারণা করা চলে।