সরকার যদি কারও কথা না শোনে তাহলে বিপর্যয় ঘটবে
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ কুমিল্লার বেসরকারি ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষক। যুক্তরাজ্যের ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্নকারী তোফায়েল আহমেদের জন্ম ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামে।
সমকাল: জাতীয় নির্বাচন কার অধীনে হবে, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। সরকার বলছে, সংবিধান মেনে নির্বাচন হবে। কেউ জাতীয় সরকারের কথা বলছেন, আবার কেউ বাতিলকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের কথা বলছেন। আপনার মতটা জানতে চাই।
তোফায়েল আহমেদ: এ সবই হচ্ছে অনুমান; আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। কংক্রিট কী শেপ নেবে, তা বলা যাচ্ছে না। আমার প্রথম কথা হলো, ২০১৪ এবং '১৮ সালে যে নির্বাচন হয়েছে, সেটা যে অবস্থায় বা যে পদ্ধতিতে হয়ে থাকুক, তা ভবিষ্যতের জন্য কোনো গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি নয়। এখানে পরিবর্তন আনতেই হবে। ক্ষমতাসীনরা এককভাবে নির্বাচন করলে তার গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। নির্বাচন তারা করতে পারে, তবে তা হবে গায়ের জোরে। সরকার, বিভিন্ন বাহিনী, সমস্ত প্রশাসন, বৃহত্তম দল হিসেবে তাদের সহযোগী সংগঠনগুলো- সবাই মিলে একটা যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করে আগে যা করেছে তেমন একটা নির্বাচন করে নিতে পারে। কিন্তু সেটা নির্বাচন হবে না; নির্বাচনের একটা আনুষ্ঠানিকতা হতে পারে মাত্র।
সমকাল: সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তাহলে কী করতে হবে?
তোফায়েল আহমেদ: যদি তারা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় গুণগত পরিবর্তন আনতে চায় তাহলে বেশ কয়েকটি প্রস্তাব এখন টেবিলে আছে। কোনোটা কংক্রিট না হলেও এগুলো নিয়ে আলোচনা হতে পারে। বিএনপি কিন্তু পরিস্কার বলেছে- এ সরকারের অধীনে তারা কোনো নির্বাচন করবে না। অন্য বিরোধী দলগুলো প্রায় একই কথা বলছে। দেখা যাচ্ছে, সরকার এখন একা। তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে- তারা কি একা চলবে, না সবাইকে নিয়ে একটা নির্বাচন করবে। যাঁরা বলছেন বিএনপি তো আন্দোলন করতে পারছে না; তাঁদের উদ্দেশে আমার কথা হলো, দাবি তো উঠেছে। এখন সরকার যদি তা না শোনে তাহলে সেটা সন্ত্রাসের দিকে চলে যাবে। কোনো শান্তিকামী নাগরিক এটা চায় না। আমরা চাই তাঁরা পরস্পর কথা বলুন। ওপরের দিকে না হলেও মাঝারি সারির নেতাদের মধ্যে পর্দার অন্তরালে হলেও কথা হোক; একটা সমাধান বের হয়ে আসুক। বিএনপিও দেশটিকে খাদের কিনারায় নিতে চায় না; সরকার তো চাইবেই না। আন্তরিকতা নিয়ে বসলে একটা সমাধান বের হবেই।
সমকাল: আপনি আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে সংলাপের কথা বলছেন?
তোফায়েল আহমেদ: হ্যাঁ। দেখুন, সামনে কিন্তু একটা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শঙ্কা দেখা যাচ্ছে। এটার জন্য সরকার এককভাবে দায়ী, তা বলা যাবে না। বৈশ্বিক পরিস্থিতি আছে এবং দীর্ঘদিন একটা সরকার ক্ষমতায় থাকলে যা হয়, তাও আছে। কিন্তু এখন যদি সরকার বলে, যা করেছি ঠিক করেছি; কারও কথা শুনব না; তাহলে দেশে বিপর্যয় ঘটবে। সবাইকে নিয়ে চলতে হবে। এ জন্য কথা বলতে হবে।
সমকাল: ১৯৯১-এর নির্বাচনের আগে তিন জোটের পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা আসার পর বিশেষ করে বাম জোটের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, অন্তত আগামী তিনটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে হবে। সে অনুসারে ওই ধরনের সরকার ব্যবস্থায় তিনটি নির্বাচন আমরা পেয়েছি। প্রশ্ন উঠেছে, এ ধরনের সরকারের অধীনে কি অনির্দিষ্টকাল নির্বাচন হবে?
তোফায়েল আহমেদ: দেখুন, তিনটি নির্বাচন হওয়ার পরও আরেকটা নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হলে কোনো সমস্যা হতো না। তখন যা ঘটেছে সব ছিল স্টেজ ম্যানেজড। না বলে পারছি না, ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর শাসক দলের বেশ কিছু সভা-সমিতিতে অনেককে বলতে শোনা গেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলে যদি 'মুক্তিযুদ্ধবিরোধী' সরকার আসে, তাহলে আমরা গণতন্ত্র চাই না। ঠিক ওই মডেলে তারা এগিয়েছে। বিচারপতি খায়রুল হকের রায় ও সংবিধান সংশোধন খেয়াল করলেই তা বোঝা যাবে। দুনিয়ার কোথাও সংসদ রেখে সংসদ নির্বাচন হয় না। কিন্তু সংবিধান সংশোধন করে আমাদের এখানে তা করা হলো।