সম্প্রদায়গত ঐক্যের চেয়েও সামাজিক ঐক্য গুরুত্বপূর্ণ

সমকাল মযহারুল ইসলাম বাবলা প্রকাশিত: ২৮ এপ্রিল ২০২২, ০৯:১৬

বাঙালি অধিক উৎসবপ্রেমী। সামাজিক নানা উৎসবের পাশাপাশি ধর্মীয় এবং জাতীয় উৎসব রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন উৎসব। এসব উৎসবে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অবদান ও অংশগ্রহণ সর্বাধিক। উচ্চবিত্তের অনেকেই নিজেদের শ্রেণিগত মানমর্যাদা রক্ষার অজুহাতে সামাজিক উৎসবে শামিল হতে চান না। শ্রেণিগত নিজ নিজ সমাজেই তারা সীমাবদ্ধ। তারা নিজেদের মতো উদযাপন করেন উৎসব। সেখানে ভিন্ন সংস্কৃতির কারণে তাদের পালিত উৎসব আর দেশজ উৎসব থাকে না।


জাতির চেয়েও শ্রেণি যে অধিক শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান- সেটা সমাজের শ্রেণিবিন্যাসে খুবই স্পষ্ট। আমাদের সমষ্টিগত মানুষ কিন্তু উৎসবকেন্দ্রিক ভোগ-বিলাসের এই প্রতিযোগিতা থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হয় অর্থনৈতিক কারণে। তবে উৎসবপ্রীতি যে সংখ্যাগরিষ্ঠদের নেই- সেটা কিন্তু বলা যাবে না। তারাও উৎসব পালন করে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী। দারিদ্র্যের একঘেয়ে, নিরানন্দ জীবনে উৎসব নিশ্চয় বৈচিত্র্যের বারতা নিয়ে উপস্থিত হয়। সে কারণে সব আর্থিক সীমাবদ্ধতা ডিঙিয়ে তারা সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করে পরিবার-পরিজন সমেত উৎসব পালনে। ঈদ নিশ্চয় ধর্মীয় উৎসব। এই সামাজিকতার বৃহৎ পরিসরে সব ধর্মাবলম্বীর অংশগ্রহণের সুযোগ কিন্তু রয়েছে। অতীতে ঈদ ও পূজায় বাঙালি হিন্দু-মুসলমান ধর্মাবলম্বীরা পরস্পর সামাজিকতায় যুক্ত হয়ে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করতেন। একে অপরের গৃহে নিমন্ত্রিত হয়ে যাওয়া-আসাও করতেন। ১৯৪৭-এর দেশভাগ কেবল অখণ্ড ভূখণ্ডকেই ভাগ করেনি; ভাগ করেছে দুই সম্প্রদায়ের মানুষের হৃদয়কেও।


বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর আমাদের প্রত্যাশা ছিল, সম্প্রদায়গত বৈরী বিভাজন-বিভক্তির ঘৃণিত সাম্প্রদায়িকতার অবসান ঘটবে। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভিত্তিমূলে যে ধর্মনিরপেক্ষতা, তা সমাজ ও রাষ্ট্রে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা পাবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাস্তবে তেমনটি ঘটেনি। বরং রাষ্ট্রের আত্মপরিচয়ে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রবর্তিত হয়েছে। সেই '৪৭-এর অভিমুখেই যেন আমাদের পশ্চাদ্‌গমন। আমরা উৎসবকে খণ্ডিত না করে উৎসবের আধিক্য বৃদ্ধিতে অধিক আগ্রহী। অতীতে অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের সম্প্রীতিতে নূ্যনতম বিরূপ বিভাজন ছিল না। উত্তর ইরাকের কুর্দিভাষী সুন্নি মুসলমান ছাড়া গোটা ইরাকের মানুষের ভাষা আরবি। কুর্দিদের জাতীয়তা অর্থাৎ ভাষার টান ছিল গভীর। কিন্তু তারাও আরবি ভাষা জানত এবং বলত। তবে নিজ ভাষা-সংস্কৃতিকে ত্যাগ না করে নিজেদের জাতিসত্তার স্বাতন্ত্র্যকে প্রাধান্য দিতে গর্ববোধ করত। ব্রিটিশ ও ফ্রান্সের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ সাইকম-পিকো চুক্তিতে কুর্দিস্তানকে বিভক্ত করে রাষ্ট্রাধীনে ভাগ করে দেয়। সিরিয়া, ইরান, তুরস্ক ও ইরাক- এই চার দেশেই কুর্দিভাষীরা সুদীর্ঘকাল ধরে প্রতিটি রাষ্ট্রের মূলধারা থেকে বঞ্চিত, অধিকারহারা ব্রাত্যরূপে বসবাস করে আসছে। সম্প্রদায়গত মিল থাকলেও জাতীয়তার অমিলের কারণেই কুর্দিরা ওই চার রাষ্ট্রে নিগৃহীত হচ্ছে। এতে পরিস্কার বোঝা যায়, সম্প্রদায়গত ঐক্যের চেয়েও অধিক দৃঢ় জাতীয়তা এবং সামাজিক ঐক্য।


ঈদের আবেদন পুরোপুরি সামাজিক। তবে পুঁজিবাদী তৎপরতায় সামাজিকতা ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে। ঈদের সব আনুষ্ঠানিকতার কেন্দ্রে রয়েছে সম্প্রীতির সামাজিকতা। পারিবারিক ঝগড়া-বিবাদের কারণে আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়। এমনকি পরস্পর কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ঈদ এলে দেখা যায়, পরস্পর ঈদের সামাজিকতায় অতীতের বিভক্তি ভুলে কোলাকুলি ও কুশল বিনিময় করেন। একে অপরের বাড়িতে যেতেও বাধ্য হন। এ ধরনের ঘটনা শোনা ও দেখার অভিজ্ঞতা কমবেশি আমাদের অনেকেরই রয়েছে। সম্প্রীতি স্থাপনে ঈদের আবেদন তাই সর্বাধিক বলেই গণ্য। সংগত কারণেই ধর্মীয় উৎসব ঈদ কিন্তু সামাজিক উৎসব। বৈষম্যের প্রসঙ্গে যদি বলি তবে সমাজে কোন ক্ষেত্রে ধনী-নির্ধনের বৈষম্য নেই? সব ক্ষেত্রেই বৈষম্য বিরাজমান। ঈদে খাবারও শ্রেণিগত অবস্থার ভিত্তিতে ভিন্ন হয়ে থাকে। সমাজে ধনী-নির্ধনের বৈষম্য যতদিন সক্রিয় থাকবে, ততদিন এই অমানবিকতার অবসান ঘটবে না।


ঈদের আনুষ্ঠানিকতা, উৎসব পালন শ্রেণি বিভাজনের মতো সমাজে বিভাজিত। এক পক্ষ দেবে, অপর পক্ষ অর্থাৎ দরিদ্র মানুষ হাত পেতে নেবে। এতে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য ঘুচবে না। এক দিনের এই উৎসব নিয়ে বিত্তবান-মধ্যবিত্তদের আনন্দ আর সমষ্টিগত মানুষের উৎসব-আনন্দ এক নয়। কে কয়টি এবং কত দামি পোশাক কিনেছেন- এ নিয়ে সংখ্যালঘু বিত্তবান-মধ্যবিত্তের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায়। তবে ঈদের মৌলিক সামাজিকতা কিন্তু এখন আর আগের মতো পালিত হতে দেখা যায় না। আত্মীয়-পরিজন পরস্পরের বাড়িতে যাওয়া-আসাও সেভাবে করেন না। ফেসবুক, খুদেবার্তা, বড় জোর ফোনালাপে ঈদের সামাজিকতা পালনের অদ্ভুত সংস্কৃতি আমাদের জীবনাচারে গভীরভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছে। সামষ্টিক সামাজিকতার টানাপোড়েন চলছে সমাজে। তাই সামাজিকতার সর্ববৃহৎ এই ঈদ উৎসব ক্রমেই তার আবেদন হারাচ্ছে। আমাদের সমাজজুড়ে যে বিচ্ছিন্নতা আমরা প্রত্যক্ষ করি; ঈদের উৎসবেও তার ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয় না। আত্মকেন্দ্রিকতার জোয়ারে ঈদের নির্মল আনন্দ-ঐতিহ্যের আবেদন একে একে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এ জন্য ব্যক্তি দায়ী নয়; দায়ী হলো ব্যবস্থা।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও