প্রাণ ছিল ওই সদরঘাটেই
দেখতে দেখতে স্কুল একশ’ পঁচিশ বছরে পা দিয়েছে। দেখতে দেখতে তো বটেই। আমার নিজের বয়সই তো আশি পার হয়েছে। ওই ভাবেই, সচেতনতার বাইরেই। স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম সেই ১৯৪৮ সালে। সে তো প্রায় সত্তর বছর আগের ঘটনা। এমনই হয়।
এত বছর কত ছাত্র পার হয়ে গেছে আমাদের সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল থেকে। পাঠশালা যেন পান্থশালা, এটা তো কোনো বাড়িয়ে বলা নয়, খুবই সত্য কথা। স্কুল থেকে আমরা পেয়েছি অনেক কিছু, বিনিময়ে কী দিতে পারি, এক কৃতজ্ঞতা ছাড়া, সে কৃতজ্ঞতাই বা প্রকাশ করবার উপায় কী? একাধিক স্কুলে আমাকে পড়তে হয়েছে, একেবারে বাল্যকালে সূত্রপাত গ্রামের পাঠশালায়, অল্পদিনের জন্য; তারপরে রাজশাহী মিশনারি গার্লস স্কুল, সেও বেশি দিন নয়, এরপরে রাজশাহীরই লোকনাথ হাইস্কুলে, বেশ কয়েক বছর আরও পরে কলকাতার সেন্ট বারনাবাস স্কুলে, তবে পুরো বছর নয়, সেখান থেকে ময়মনসিংহের জেলা স্কুলে, কয়েক সপ্তাহের জন্য, সবশেষে সেন্ট গ্রেগরিজে, সেখানে আমি পড়েছি ক্লাস নাইন ও টেনে। এই শেষ পড়াটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল আমার জন্য, সর্বাধিক প্রভাবশালী তো অবশ্যই। এখান থেকেই ম্যাট্রিক পাস করি আমি, ১৯৫০ সালে। ম্যাট্রিক নয়, তখন নাম ছিল হাই স্কুল একজামিনেশন।
পাস করলাম। হাই স্কুল ছাড়লাম, আরও উঁচুতে উঠলাম। কিন্তু ছাড়লাম কি? না, ঠিক ছাড়া হয়নি। কলেজে গিয়েও স্কুলেই রয়ে গেলাম। স্কুল তখন সবেমাত্র কলেজ শাখা খুলেছে, আমার আব্বা নিশ্চয়ই তক্কে তক্কে ছিলেন, নইলে অত দ্রুত, আমার বুঝে ওঠার আগেই সেই কলেজে ভর্তি করে দেবেন কেমন করে? স্কুলের নামই কলেজের নাম, সেন্ট গ্রেগরিজ কলেজ, পরে তার পরিচয় দাঁড়িয়েছিল নটরডেম কলেজ হিসেবে। কেবল তাই নয়, প্রথম দিকে কলেজের কোনো নিজস্ব ভবন ছিল না, বসত সে স্কুলের কয়েকটি কক্ষেই, প্রতিদিন, স্কুল শুরু হওয়ার আগে, প্রত্যুষে। স্কুল থেকে বের হয়েও তাই বের হতে পারিনি। ব্রাদারদের পরিচালনায় ছিলাম, এবার এলাম ফাদারদের তত্ত্বাবধানে। কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য কলেজ নতুন একটা বাড়িতে উঠে গিয়েছিল, কিন্তু সেটাও ওই লক্ষ্মীবাজারেই, এবং স্কুল থেকে এক দৌড়ে পৌঁছা যায় এমন দূরত্বেই।
ঢাকায় আমরা এসেছি ১৯৪৭ এর শেষে, দেশভাগের কারণে। প্রথমে যেতে হয়েছিল ময়মনসিংহে, সেখান থেকে মোটামুটি স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য এলাম ঢাকায়। খোঁজ পড়ল স্কুলের। আমার বাবা মিশনারিদের স্কুলের ওপর খুবই আশা রাখতেন, সে জন্য আমার শিক্ষাজীবনের শুরু রাজশাহীর মিশন গার্লস স্কুলে কিন্তু সেখানে তো শিশুশিক্ষা পর্যন্ত সম্ভব, তারপরে ছেলেদের স্কুল খুঁজে নিতে হয়েছে। রাজশাহীতে মিশনারিরা ছেলেদের জন্য কোনো স্কুল খোলেনি, তাই বোধ করি বাধ্য হয়েই আব্বা আমাদের দুই ভাইকে পাঠিয়েছিলেন সেখানকার লোকনাথ হাই স্কুলে। কলকাতায় গিয়ে মিশনারি স্কুল পেয়ে সেখানে দিলেন ভর্তি করে। ময়মনসিংহে মিশনারি স্কুল নেই, তবে কলেজিয়েট স্কুল সবার সেরা, তাই সেখানে যেতে হলো। ঢাকায় এসে তার চোখ ছিল সেন্ট গ্রেগরিজের ওপর। একে মিশনারিদের দ্বারা পরিচালিত, তাও আবার খুব ভালো বলে উচ্চ প্রশংসিত। সে স্কুলে আব্বার বগলদাবা হয়ে আমরা দু’ভাই গিয়ে হাজির হয়েছি। আমার ভাইটিকে সেভেনে ও আমাকে নাইনে ভর্তি করার পরে মনে হলো তিনি নিশ্চিত হয়েছেন।