জাতীয়তাবাদ সর্বজনীন হলো না
জাতি সমস্যার মীমাংসা দেশভাগের মধ্য দিয়ে করার উপায় ছিল না। সাতচল্লিশের পরে ভারতের দেশি শাসককর্তারা অঙ্গীকার করেছিলেন, দেশে তারা একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়ে তুলবেন। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে তারা বুঝিয়েছেন সব ধর্মকে সমান মর্যাদা দান; যার অর্থ গিয়ে দাঁড়ায় রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্ম চর্চাকে উৎসাহিত করা। মহাত্মা গান্ধী অসাম্প্রদায়িক ছিলেন, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন না। তার অসাম্প্রদায়িকতাকে কট্টরপন্থি হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা সহ্য করতে পারেনি। তারা তাকে হত্যা করেছে। আর ওই হত্যার সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, তাদের উত্তরাধিকারীরা শেষ পর্যন্ত স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতা করতলগত করতে সমর্থ হয়।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিয়েছেন যে মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ, মনে মনে তিনি হয়তো আশা করেছিলেন, পাকিস্তানে একটি ধর্মনিরপেক্ষ পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলবেন। কিন্তু কাজটা ছিল ঠিক ততটাই অবাস্তবিক, যতটা অবাস্তবিক ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রকে স্থায়ী করে রাখার স্বপ্টম্ন। কারণ পাকিস্তান কোনো একটি জাতির দেশ ছিল না। যেখানে বাঙালি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, পাঠান ও বালুচ- এই পাঁচটি বসবাস জাতি ছিল, যাদের ভাষা এক নয়, স্বতন্ত্র বটে। জিন্নাহ এবং তার অনুসারীরা ভেবেছিলেন উর্দু ভাষাকে কেন্দ্রে রেখে তার সাহায্যে নতুন একটি জাতির প্রতিষ্ঠা ঘটাবেন। কিন্তু অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা সে প্রস্তাবটিকে উত্থাপনের সঙ্গে সঙ্গেই নাকচ করে দিয়েছেন।
বাঙালি ভেবেছিল, পাকিস্তান তাদের মুক্তি দেবে। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই তারা টের পেয়েছে, ওই আশা মরীচিকা মাত্র। তখন তারা ভাষাভিত্তিক ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের পতাকাতলে একত্র হয়েছে এবং আন্দোলন করেছে। যার ফল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাঙালিদের শ্রেণি সমস্যার সমাধান করেনি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের অনুভূতিটা ছিল মূলত মধ্যবিত্তের। তাদের দ্বারা বিকশিত এবং তাদের স্বার্থসংবলিত; তাতে মেহনতি মানুষকে নামে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও তাদের স্বার্থ কার্যত সংরক্ষণ সম্ভব ছিল না। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফলেই বাংলাদেশের অভ্যুদয়, কিন্তু ওই জাতীয়তাবাদী সাফল্যে শ্রেণিভেদের অবসান ঘটেনি। সেটা বরং বৃদ্ধিই পেয়েছে। বাংলাদেশে উন্নতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এবং বলা যায়, তাকে পেছনে ফেলেই বৈষম্যের বৃদ্ধি ঘটেছে। এমন আগে কিন্তু ছিল না। বৈষম্য বৃদ্ধির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও স্থির প্রমাণ হচ্ছে তিন ধারার শিক্ষা। আর বৈষম্য বৃদ্ধির কারণ হলো, এটা যে উন্নতির গৃহীত দর্শন ও ধরন দুটোই দাঁড়িয়েছে পুঁজিবাদী।
বাংলাদেশের জন্য আসলে যেটা প্রয়োজন ছিল, জাতীয়তাবাদের অর্জনকে সমাজতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাওয়া। বলা বাহুল্য, সে কাজটা জাতীয়তাবাদীদের কাছ থেকে মোটেই প্রত্যাশিত নয়। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সামাজিক বিপ্লব আবশ্যক। সে বিপ্লব এ দেশে ঘটেনি। বড় রাষ্ট্র ভেঙে ছোট রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটেছে, কিন্তু মানুষের মুক্তির জন্য যে সামাজিক বিপ্লব আবশ্যক ছিল, সেটা ঘটানো সম্ভব হয়নি। বরং দেখা গেছে, নতুন রাষ্ট্র পুরোনো রাষ্ট্রের চাইতে অধিকতর তীব্রতার সঙ্গে সামাজিক বিপ্লবকে প্রতিহত করার দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনামলে, ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে যে সামাজিক সম্পর্ককে স্থায়ী করার চেষ্টা হয়েছিল, সেটাই বহাল রয়েছে। সুযোগপ্রাপ্ত ও সুযোগবঞ্চিতদের মধ্যকার সম্পর্কটা তখন দাঁড়িয়েছিল জমিদার ও প্রজার; সে সম্পর্ক সর্বত্র পুনরুৎপাদিত হচ্ছে, বিরামহীন গতিতে। সামাজিক বিপ্লব সম্পন্ন করার দায়িত্ব জাতীয়তাবাদীদের নেওয়ার কথা নয়। তাদের ভেতর যারা দক্ষিণপন্থি তারা তো পুরো মাত্রাতেই বিপ্লববিরোধী। উদারপন্থিরা কিছুটা ছাড় দিতে প্রস্তুত; কিন্তু সমাজতন্ত্রের ব্যাপারে তাদের রয়েছে অন্তর্গত অনীহা।
- ট্যাগ:
- মতামত
- জাতীয়তাবাদ