আমার বন্ধু সৈয়দ আবুল মকসুদ
আমার বন্ধু সৈয়দ আবুল মকসুদ। মকসুদ ভাই সমবয়সী হলেও আমরা পরস্পরকে ভাই বলে ডাকতাম—আমার শুধু বন্ধুই ছিলেন না, তিনি ছিলেন আমার বহুদিনের সহযাত্রী ও সহযোদ্ধা। আমরা গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে একত্রে নানা ইস্যু নিয়ে লড়াই-সংগ্রাম করেছি। প্ল্যাকার্ড হাতে রাস্তায় দাঁড়িয়েছি, মিছিলে যোগ দিয়েছি, জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় অংশ নিয়েছি। দেশের আনাচকানাচে গিয়েছি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। এমনকি বিদেশেও গিয়েছি সেমিনারে অংশ নিতে। আমাদের এ ঘনিষ্ঠতা পারিবারিকবন্ধনে পরিণত হয়েছিল। আমার এই বহুদিনের সহযাত্রী হঠাৎ করেই চলে গেলেন মেঘ ছাড়া বজ্রপাতের মতো। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘যত বড় হও/তুমি তো মৃত্যুর চেয়ে বড়ো নও’—আবারও তা সত্যে পরিণত করে তিনি কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই আমাদের থেকে বিদায় নিলেন।
মকসুদ ভাইয়ের মৃত্যু ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। এটি সত্য যে আপনজনের কাছে সব মৃত্যুই অপ্রত্যাশিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত। সব পরিবারই আপনজনের মৃত্যুতে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষত বয়োজ্যেষ্ঠদের মৃত্যুতে পরিবার বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ, বয়োজ্যেষ্ঠদের মৃত্যুতে পরিবার শুধু তাদের অর্থনৈতিক সহায়তা থেকেই বঞ্চিত হয় না, বঞ্চিত হয় তাদের অভিভাবকত্ব থেকেও—যে অভিভাবকত্ব সাধারণত বটবৃক্ষের মতো ছায়া ও সুরক্ষা দেয়। সেদিক থেকে মকসুদ ভাইয়ের মৃত্যু এক অপূরণীয় ক্ষতি।
মকসুদ ভাইয়ের মৃত্যু থেকে ক্ষতির মাত্রা অপূরণীয়, কারণ তাঁর পরিবার ছিল অনেক বড়, সারা দেশে বিস্তৃত—টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত। দেশের অগণিত মানুষের তিনি ছিলেন অভিভাবক, আপনজন। তিনি তাদের পক্ষে কথা বলতেন। প্রতিবাদ করতেন। দেনদরবার করতেন। তিনি তাদের দাবিদাওয়া তুলে ধরতেন। সব ধরনের দাবিদাওয়া—পরিবেশ থেকে ভোটাধিকার পর্যন্ত, এমনকি ব্যক্তিগত দাবিদাওয়াও। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন ক্রম সংকুচিত নাগরিক সমাজের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব। নাগরিক সমাজের কোনো প্রতিবাদই তাঁকে ছাড়া হতো না। তিনি কর্তৃপক্ষের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে প্রতিবাদ করতেন অসম সাহসিকতার সঙ্গে। তাঁর প্রতিবাদের ভাষা ছিল বুদ্ধিদীপ্ত ও অনেক ক্ষেত্রেই জুতসই। তিনি অন্যায়কে অন্যায় বলতে দ্বিধা করতেন না। তাই মকসুদ ভাইয়ের মৃত্যুতে পুরো জাতি যেন তাদের অভিভাবক হারালেন।
- ট্যাগ:
- মতামত
- স্মরণ
- সৈয়দ আবুল মকসুদ