‘এভাবে চললে বেতনের একটা অংশ তো যাতায়াতেই চলে যাবে’
মিরপুর ৬–এর বাসা থেকে গুলশানে রওনা দেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মাহমুদুর রহমান। এই পথটুকু যেতে তাঁর সাধারণত ২৫ টাকা লাগে। কিছু দূর হেঁটে, কিছু দূর রিকশায় করে যেতে আজ মঙ্গলবার তাঁর ১৫০ টাকা খরচ হয়েছে। মাহমুদ বলেন, ‘গতকালও একইভাবে কষ্ট করে অফিসে গিয়েছি, ফিরেছি। গতকাল খরচ হয়েছে ২৬০ টাকা। অফিস যাতায়াতের কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। দৈনিক এভাবে আসা কঠিন। এভাবে চললে বেতনের একটা অংশ তো যাতায়াতেই চলে যাবে।’
দেশের করোনা সংক্রমণরোধে সাত দিনের লকডাউনের প্রথমদিন ছিল গতকাল সোমবার (৫ এপ্রিল)। এদিন অন্যান্য দিনের মতো চিরচেনা অবস্থা না দেখা গেলেও রাজধানীর সড়কে বাস ছাড়া সবই চলাচল করেছে। আর সেই সঙ্গে সড়কে অনেক মানুষও দেখা গেছে। কেউ দৈনন্দিন কাজে বের হয়েছেন, আবার কেউ জীবন-জীবিকার তাগিদে। তবে গণপরিবহনের চাপ কম থাকায় ট্রাফিক সিগন্যালে কাউকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। অন্যান্য দিন সকালে রাস্তায় অফিসগামী যাত্রীদের চাপ থাকলেও সেরকম কিছু দেখা যায়নি আজ।
লকডাউন: পথের ভোগান্তি মেনে কাজে শ্রমিকরা
সারাদেশে ‘লকডাউনের’ প্রথম দিন গতকাল সোমবার আগের মত সচল ছিল শিল্প-কারখানা। ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজে যান শ্রমিকরা। কাজে যাওয়ার পথে সড়কে অবশ্য তাদের বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। এক সপ্তাহের লকডাউন শুরুর প্রথম দিন রাজধানী ঢাকাসহ আশেপাশের শিল্প অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে ঢিলেঢালা ভাব থাকলেও চলেনি গণপরিবহন।
৫ এপ্রিল থেকে সারাদেশে লকডাউন ঘোষণা
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় গত ৩ এপ্রিল লকডাউনে যাওয়ার কথা জানায় সরকার। ওইদিন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তার সরকারি বাসভবনে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ৫ এপ্রিল থেকে সারাদেশে লকডাউনের কথা জানান।
লকডাউনে বন্ধ থাকবে অফিস-মার্কেট, খোলা থাকবে শিল্পকারখানা
লকডাউনের মধ্যে জরুরি সেবা দেয়া প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব ধরনের সরকারি বেসরকারি-প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে খোলা থাকবে শিল্পকারখানা। গত ৩ এপ্রিল জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘মানুষের চলাফেরা যাতে কমাতে পারি সেজন্য আমরা আপাতত এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন দিচ্ছি। আমাদের জরুরি সেবা দেয়া প্রতিষ্ঠান, ডিসি অফিস, ইউএনও অফিস, ফায়ার সার্ভিসের অফিস, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অফিস, সংবাদপত্র অফিস- এই ধরনের অফিস খোলা থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘লকডাউনের মধ্যে শিল্পকারখানা খোলা থাকবে, সেখানে একাধিক শিফট করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাতে শ্রমিকরা কাজ করেন- সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে তো আবার গত বছরের মতো শ্রমিকদের বাড়ি যাওয়ার ঢল শুরু হয়ে যাবে।’
দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকাতে প্রস্তুতি কম
করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় স্বাস্থ্য বিভাগ কার্যত কোনো পরিকল্পনা নেয়নি। জনস্বাস্থ্যবিদেরা কঠোর পদক্ষেপের পক্ষে কথা বলছেন। তবে সরকার বেছে নিয়েছে মধ্যপন্থা।
করোনা সংক্রমণ দ্রুত বেড়ে যাওয়ার মুখে সরকার পর্যটন বন্ধ করল প্রথমে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায়, পরে কক্সবাজারে ও সারা দেশে। একই সময় দেশের সব জায়গায় পর্যটন বন্ধের সিদ্ধান্ত কেন হলো না, তা কেউ জানে না। সরকার গণজমায়েত বা সমাবেশ না করার পরামর্শ দিলেও গতকাল শুক্রবার ব্যাপক জনসমাগমের মধ্য দিয়ে এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলো। এই পরীক্ষা পেছালে বিশেষ কোনো ক্ষতি হতো না। ইউরোপ ও অন্য ১২টি দেশ থেকে যাত্রী আসার ব্যাপারে কড়াকড়ি করল ঠিকই, কিন্তু সংক্রমণ পরিস্থিতি অনেক দূর গড়ানোর পর। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের করোনার টিকার সবচেয়ে ভালো সুরক্ষা পাওয়া যায় প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার সময়ের পার্থক্য যদি ১২ সপ্তাহ হয়। স্বাস্থ্য বিভাগ প্রথমে দুই ডোজের সময়ের পার্থক্য করেছিল চার সপ্তাহ, পরে আট সপ্তাহ। গত এক বছরে এ ধরনের ঘটনার আরও অনেক উদাহরণ আছে।
দেশে গত বছর জুন-জুলাই মাসে করোনার সংক্রমণের প্রথম ঢেউ ছিল বেশ তীব্র। এ বছর মার্চে শুরু হয়েছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে এবার সংক্রমণ বেশি তীব্র। প্রথম ঢেউয়ের চূড়ার (পিক) চেয়ে দ্বিতীয় ঢেউয়ের শুরুতেই দৈনিক রোগী শনাক্ত বেশি হচ্ছে।
প্রতিদিন দেশে করোনাভাইরাসে শনাক্তের নতুন রেকর্ড হচ্ছে। মৃত্যুও বাড়ছে। গত বছরের মার্চে সংক্রমণ শুরুর পর থেকে এতটা খারাপ পরিস্থিতি আর দেখা যায়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত বছরের ২৫ জুন থেকে ৪ জুলাই পর্যন্ত ১০ দিন সংক্রমণ বেশি ছিল। সে সময় দৈনিক গড়ে ৩ হাজার ৭০১ জনের করোনা শনাক্ত হয়। গড়ে দৈনিক মৃত্যু হয় ৪১ জনের।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের আইসিইউ'র জন্য হাহাকার
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়ছে ব্যাপক হারে। রাজধানী ঢাকায় অনেক কোভিড-১৯ রোগী হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেও ভর্তি হতে পারছেন না -এমন অনেক অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, সংক্রমণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ার কারণে হাসপাতালগুলো ইতোমধ্যেই পূর্ণ হয়ে গেছে।
‘করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নয়, এটা এখন সুনামির ঢেউ’
‘করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নয়, এটা এখন সুনামির ঢেউ’, এমন শঙ্কা প্রকাশ করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন: দেশের করোনা পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠার আগেই কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা প্রয়োজন।
একইসাথে তারা মনে করেন: জরুরি ভিত্তিতে তবে সুনির্দিষ্ট টার্গেট করে, কোথায় কোথায় মানুষ বেশি সংক্রমিত বেশি হচ্ছে সেটা বের করতে হবে। এর পাশাপাশি সরকারের ঘোষিত ১৮টি সিদ্ধান্তকে অবশ্যই পালনীয় নির্দেশ হিসেবে নিয়ে তা পালনে যা যা করার দরকার সরকারকে তা করতে হবে। বিশেষ করে এবার ‘সীমিত আকারে’ শব্দটি উচ্চারণ করা যাবে না মোটেও।