‘যত দূর দেখা যায়, বিলের অবারিত উদারতা, চোখের দৃষ্টি কোথাও বাধা পায় না, ছুটতে ছুটতে অবশেষে ধোঁয়া আর কুয়াশা আর মেঘ মিলিয়ে যেখানে দিগন্তের মতো রচনা করেছে।’
সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশী (১৯০১-১৯৮৫) চলনবিলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এমন বর্ণনা দিয়েছিলেন। সেই বর্ণনার সঙ্গে এখন আর চলনবিলের মিল পাওয়া যায় না। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় এই বিলে দৃষ্টি ঢেকে দেয় সরকারি-বেসরকারি প্রকল্প, খামার, সারি সারি পুকুর ও পুকুরপাড়ের কলাগাছ। অন্যদিকে বিলের পানিপ্রবাহ বাধা পাচ্ছে ভরাট হয়ে যাওয়া খাল, হঠাৎ গজিয়ে ওঠা পুকুরের পার কিংবা অপরিকল্পিত সড়ক, বাঁধ ও স্লুইসগেটে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলে থাকেন, এই বিলে সব সময় পানি বয়ে চলার কারণেই নাম হয়েছে চলনবিল। কিন্তু বাস্তবে চলনবিলের শ্বাসরোধের মতো অবস্থা। নদী ও খালের পানির প্রবাহ বাধা পেয়ে এখন বিলে পর্যাপ্ত পানি আসতে পারে না।
নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার বিস্তৃত এই বিল একসময় ৪৭টি নদীর সঙ্গে যুক্ত ছিল। তবে গত পাঁচ দশকে নদী-খাল ভরাট, অপরিকল্পিত পোল্ডার ও সড়ক নির্মাণে পানিপ্রবাহ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারের পানি উন্নয়ন বোর্ডের ট্রাস্টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান
সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস)-এর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৫ সালে মার্চে (শুষ্ক মৌসুম) চলনবিলে ৮০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় পানি ছিল। ২০২৫ সালে এসে তা নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬৬ বর্গকিলোমিটারে—অর্থাৎ ৯২ শতাংশ কমে গেছে।
চলনবিলের চরিত্র বিনষ্ট হয়েছে
চলনবিলের প্রধান প্রধান অংশ গত ২৬, ২৭ ও ২৮ জুলাই ঘুরে দেখেছি। ২৬ জুলাই চাটমোহর উপজেলার ছাইখোলা ইউনিয়নের বোয়ালমারী ব্রিজের নিচে রামনগর গ্রামের চাষিদের পাট নামাতে দেখলাম। এখনো বিলে পর্যাপ্ত পানি নেই দেখে পাটের মালিক রামনগর গ্রামের কৃষক তাজিম উদ্দিন (৬৫) বললেন, ‘পানি আইসপি কী কইরি। আসার জো নাই। নটাবাড়িয়ার সুইস গেট যে বন্ধ। দেখতেচেন না বিলডা একেবারে শুকনা। একমাজা পানিও নাই। গেট যখন খুইলে দেয়, তখন ভালো পানি আসে।’
সেতুর আরেকটু সামনে গিয়ে সড়কের উল্টো পাশে দেখা গেল আরেক দল লোক পাট ধুইছেন। বিলের পানির অবস্থা জানতে চাইলে শহিদুল ইসলাম (৪০) নামের একজন শ্রমিক বিদ্যুতের খুঁটির একটি কালো দাগ দেখিয়ে বললেন, ‘চলনবিলের পানি অত দূর পর্যন্ত ওঠে। এবার কেন হয়নি, তা আল্লাহ জানে।’
তাজিম উদ্দিনের কথামতো নটাবাড়িয়া স্লুইসগেটের কাছে গিয়ে দেখি, ১৪টি গেটের মধ্যে ২টি গেট খোলা হয়েছে। সেখানে কথা হলো নটাবাড়িয়া গ্রামের মৎস্য ব্যবসায়ী আজাদ হোসেনের (৫২) সঙ্গে। তিনি বলেন, গুমানী নদী হয়ে সব কটি নদীর পানি একযোগে এই কিনু সরকারের জোলা দিয়ে বিলে পানি যায়। এখন স্লুইসগেটের সব গেট খুলে দেওয়া দরকার। তাঁরা খোলার পক্ষে। কেন খোলে না, তাঁরা জানেন না।