চিন্তায় কেন ডিজিটালের ফাঁস
‘জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, নামে ২০১১ সালের একটা আইন আছে আমাদের। নামটা দেখে বুকে বল আসছে কি আপনার! জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বলে মনে হলেই যেকোনো তথ্য কাগজে, ফেইসবুকে, ইউটিউবে, হাটে-বাজারে যেখানে খুশি সেখানে, যেমনভাবে খুশি তেমনভাবে প্রকাশ সুরক্ষা দেওয়া হয়নি এ-আইনে। শুধু নামটুকু দেখে বা শুনেই তার সবটুকু ধারণা করে নেওয়া মস্ত বড় ভ্রান্তি। বাংলায় কেউ কখনো কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন রেখেছিল কি না ঠিক নেই, প্রবাদটি টিকে আছে। এ-আইনে ‘জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য’ বলা হয়েছে সরকারি টাকা-পয়সার অনিয়ম, সরকারি সম্পদের অব্যবস্থাপনা, সরকারি সম্পদ আত্মসাৎ, ক্ষমতার অপব্যবহার বা প্রশাসনিক ব্যর্থতা, ফৌজদারি অপরাধ, বেআইনি বা অবৈধ কাজকাম, জনস্বাস্থ্য, নিরাপত্তা বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বা ঝুঁকিপূর্ণ কার্যকলাপ এবং দুর্নীতির সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তার জড়িত থাকার তথ্য। এসব কথা যদি বলার থাকে বলতে হবে ‘উপযুক্ত কর্র্তৃপক্ষ’-এর কাছে। অর্থাৎ, সেই সংস্থার প্রধান বা সংস্থার সংযুক্ত বা অধীনস্ত অধিদপ্তর, পরিদপ্তর বা দপ্তরের বিভাগীয়, আঞ্চলিক, জেলা, উপজেলা বা ইউনিয়ন কার্যালয়ের প্রধানের কাছে। আর, সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে হলে রাষ্ট্রপতির কাছে, সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে হলে স্পিকারের কাছে, অধস্তন আদালতের বিচারকদের বিরুদ্ধে হলে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছে, দুর্নীতির বিষয় হলে দুদকের কাছে, সরকারি টাকা-পয়সার ব্যাপার হলে মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কাছে এবং অবৈধ বা অনৈতিক কাজের ব্যাপার হলে থানায়। এই আইনের ব্যবহার নেই মোটে। সুরক্ষার যা অবস্থা তাতে আশ্বস্ত হয় না তথ্য প্রদানেচ্ছুরা।
সংবিধানে ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদ নাগরিকের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। কিন্তু, তা প্রকাশের কোনো সুরক্ষা দেওয়া হয়নি। বরং দেওয়া হয়েছে আইনের বেড়াজালের নিয়ন্ত্রণ। সংবাদ মাধ্যমও নেই তার বাইরে। চিন্তা করবেন স্বাধীন বিবেকে। তবে, প্রকাশ করতে গেলেই আইনের বাধা মানতে হবে। যুক্তিসংগত বাধা থাকা দরকার রাষ্ট্রের, সমাজের নাগরিকের স্বার্থে বৃহত্তর স্বার্থে। নইলে যথেচ্ছাচারে নষ্ট হবে। দেয়ালেরও নাকি কান আছে, শান্তি নেই সেখানে কথা বলে। আজেবাজে বিজ্ঞাপনী পোস্টারে দেয়ালেরও কান বন্ধ। আগে চিকা মারা হতো দেয়ালে। এখন এসেছে ফেইসবুক ওয়ালে, ডিজিটালে।
২০০৬ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ ধারায় ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশের বিধিনিষেধ ছিল। আলোচনা-সমালোচনায় সে-সব বিলোপ হয়েছে ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। সেসবই ঘুরে এসে গেছে ২১, ২৫, ২৮, ২৯ ও ৩১ ধারায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। ব্যবহার নেই ২০১১ সালের ‘জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন’-এর, অতি ব্যবহারে অপবাদ জুটেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপবলে। ২১ ধারায় মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা বা প্রচারণার দণ্ডণীয়। ২৫ ধারায় কাউকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয় করার উদ্দেশ্যে আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতিকর কিছু প্রকাশ এবং রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি, সুনাম নষ্ট করার, বা বিভ্রান্তি ছড়ানো অপরাধ। ২৮ ধারায় ধর্মীয় মূল্যবোধ, অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কিছু প্রকাশ করা অপরাধ। ২৯ ধারায় মানহানিকর কিছু প্রকাশ করা অপরাধ। ৩১ ধারায় শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা, বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় এমন কিছু প্রকাশ করা অপরাধ। কেমন ধরনের প্রকাশ, প্রচার হলে তা বিরুদ্ধ প্রপাগান্ডা হবে, অপমানকর হবে, আক্রমণাত্মক হবে, ভীতিকর হবে, ভাবমূর্তি ক্ষুণœকারী হবে, ধর্মের অবমাননা হবে, শ্রেণি-সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারী হবে, আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কা তৈরি করবে এগুলোর কোনো সংজ্ঞা দেওয়া নেই আইনে। ব্যাখ্যা দিয়ে স্পষ্ট করা হয়নি। এসবের বিস্তারিত ব্যাখ্যা এবং নমুনা ও উদাহরণ দিয়ে সুস্পষ্ট করা দরকার, ব্রিটিশরা যেমন সেই ১৮৬০ সালে দিয়ে গেছে পেনাল কোডে।