বাংলাদেশের হাতে সময় আছে আর মাত্র ২০ বছর!
আমার মামার বাড়িটা ছিল কবি জসীমউদদীনের মামার বাড়ির চেয়েও অনেক বেশি স্নিগ্ধতায় ঘেরা। একটা স্বপ্নের মায়াজালে ঘিরে থাকা সময় যেন। চোখ বন্ধ করলেই সবকিছু সজীব সিনেমার মতো ভেসে ওঠে। থ্রি-ডি নয়, ফোর-ডি নয়- একদম তরতাজা অনুভূতি।
ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলায় ঘোষপালা গ্রাম। নান্দাইল থেকে যে সুন্দর সড়কটি কিশোরগঞ্জের দিকে গিয়েছে, সেই সড়কের ঠিক পাশেই। আম্মা বাসের হেলপারকে বলতেন, ঘোষপালা সরকার বাড়ি। ব্যস, আর কিছুর দরকার নেই। বাস আমাদের ঠিক বাড়ির সামনেই নামিয়ে দিত। বাস থেকে নেমেই কয়েক গজ গেলেই বিশাল উঠান। সেই উঠানে কেউ না কেউ ধান শুকাচ্ছে, নয়তো পাশের পুকুরে গোসল করছে, নয়তো এমনি বসে হুক্কা টেনে আড্ডা দিচ্ছে।
আমরা বাস থেকে নামতেই কেউ না কেউ দেখে ফেলবে। তখন মোবাইলের যুগ ছিল না। চিঠি দিয়ে জানানো হতো। কেউ একজন চিৎকার দিয়ে বলবে, ফরিদপুরের মেহমান আইছে গো (আমরা তখন ফরিদপুরে থাকতাম বলে, আমাদের এমন নাম হয়ে গিয়েছিল।) মুহূর্তেই পুরো উঠান ভরে গেল। নানু দূরে লাঠি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমরা গিয়ে নানুকে সালাম করে, তারপর লাইন দিয়ে সব মুরব্বিকে পা ছুঁয়ে সালাম করতে হতো। কেউ আমাদের স্যুটকেস নিয়ে গেছে, কেউ পাখা দিয়ে বাতাস করছে, কেউ পানি এনে দিচ্ছে। সে কি এক মহামিলন মেলা! আমি এই বয়সেও নানুকে দেখতে পাই, বুড়ো ঠুনঠুনে - কিন্তু লাঠি হাতে পুরো বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আমরা কি খাব, বাজার থেকে কী আনা হবে- কোন পিঠা হবে, কোন মাছটা ধরা হবে- সব তদারকি করছেন। খেত থেকে তাজা সবজি, তাজা মাছ, প্রতি বেলা মাটির চুলায় রান্না করা খাবার! সেই ঘ্রাণ আমি এখনো পাই।
ভোরে উঠে গুড় দিয়ে খই, তারপর পিঠা, তারপর সকালের নাশতা (চালের রুটি দিয়ে মুরগির মাংস, আহ)! সেগুলো খেয়ে আমরা চলে যেতাম বাড়ির সামনের খেতে। বিশাল ধানখেত! কখনো মটরশুঁটি, আলুর চাষ- কী নেই! দুপুরে পুকুরে সাঁতার কেটে গোসল করে, একসঙ্গে লম্বা লাইন দিয়ে সব মামাতো খালাতো ভাইবোনরা মিলে দুপুরের খাবার। বিকেলে চারপাশের বাড়িগুলো থেকে আসা কিশোরদের সঙ্গে খেলা। সন্ধ্যার পর থেকেই ভয় ভয় অবস্থা। হারিকেন আর কুপি দিয়ে চলাচল। গরুর গোয়ালে গিয়ে ধুঁয়া দিয়ে, তারপর বড়দের আশপাশে থাকা- যদি ভূতপ্রেত এসে নিয়ে যায়। রাতে কারো হাত ধরে বাড়ির পেছনে গিয়ে টয়লেট করে কোনোরকমে ঘরে ফেরা। বাড়ির পেছনের বাঁশবাগান হলো যাবতীয় রহস্যের ঠিকানা।
তারপর যেদিন আমরা চলে আসব, তখন কান্নার যে রোল, তা বাসের লোকেরা পর্যন্ত চেয়ে চেয়ে দেখত। সে কি কান্না! পুরো বাড়ি জুড়ে কান্না। সবাই লাইন দিয়ে চোখ মুছছে। আমরাও কাঁদতে কাঁদতে বাসে কিংবা রিকশায় চড়ে স্টেশনের দিকে রওনা দিতাম। অপেক্ষা, আবার কবে যাব সেই মামাবাড়ি!
আমি নিশ্চিত, এমন মধুর স্মৃতি অনেকেরই আছে। সেই গ্রাম, মাটির গন্ধ, ফসলের ঘ্রাণ, ধানখেতের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তুলতুলে বাতাস - আর ফড়িং ধরার জন্য পেছনে পেছনে ছুটে চলার শৈশব এক অসাধারণ মায়াবি সময়।
আম্মা, মামা, খালা, নানু- এমন একটি শৈশব উপহার দিয়ে ঋণী করে গেছেন, যা পরিশোধ করা যাবে না!
দুই.
নিকোলাস কুপার্নিকাস ৭০ বছর বেঁচে ছিলেন (১৪৭৩-১৫৪৩)। তিনি মূলত ইতালিতে লেখাপড়া করেন। তারপর ৩০ বছর বয়সে নিজ দেশ পোল্যান্ডের ওয়ারমিয়াতে থাকা শুরু করেন। পরের ৪০ বছর মূলত ওখানেই কাজ করেন। ২৪ মে ১৫৪৩ সালে যেদিন তার মৃত্যু হয়, সেদিনই তার বিখ্যাত বই ‘ডি রেভুলুশনিবাস অরবিয়াম কোলেস্টিয়াম’-এর শেষ পাতাগুলো প্রকাশিত হয়।
এখন থেকে মাত্র ৪৭৭ বছর আগে কুপার্নিকাস সবাইকে জানিয়েছিলেন, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে না, বরং সূর্যের চারদিকে পৃথিবী ঘোরে। এবং কয়েক শতক ধরে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বের করছেন, ঠিক কীভাবে পৃথিবী নামক গ্রহটি ১০৮,০০০ কিলোমিটার/ঘণ্টা বেগে সূর্যের চারদিকে ঘোরে। ৩৬৫ দিনে একবার ঘুরে আসতে লেগে যায় একটি বছর।
কুপার্নিকাসের কথাটা পাড়লাম এই জন্য যে, পৃথিবীর যা বয়স (৪.৫ বিলিয়ন বছর) সেই তুলনায় কুপার্নিকাসের এই আবিষ্কার খুবই তুচ্ছ সময়। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে- এটার আবিষ্কার এখনো ৫০০ বছর হয়নি। অর্থাৎ এই ৫০০ বছর আগেও মানুষ স্পেস এবং সময় নিয়ে মৌলিক তথ্যটুকুই ভুল জানত। তাই আমরা যা ভাবছি, সেটার অনেক কিছুই সঠিক না-ও হতে পারে। কারণ, জানার এখনো অনেক কিছুই বাকি। এবং অনেক কিছু হয়তো অজানাই থেকে যাবে।
সেই সামান্য জানা দিয়েও যদি আমরা তুলনা করি, তাহলে ৪০ বছর কিছুই নয়। আমি যে ওপরের স্মৃতির কথাটা বলছিলাম, সেটা মাত্র ৪০ বছর আগের ঘটনা। এর ভেতরই অনেক পাল্টে গেছে পৃথিবী!
তিন.
আমি যখন শেষবার মামাবাড়ি গিয়েছিলাম, তাও বছর দশেক আগে হবে। কিংবা আরেকটু বেশি। তত দিনে উল্টেপাল্টে গেছে অনেক কিছুই। সেই গ্রাম আর মায়াবী গ্রাম নেই। সেই উঠান আর আগের উঠান নেই। সেখানে উঠে গেছে তাদের ছেলেমেয়েদের ইটের দেয়াল। সেই পুকুরটিও নেই। খেত ভাগ হয়েছে অনেক। আইলের পর আইল বসেছে। কুপির আলোতে যে স্নিগ্ধতা ছিল, বর্তমানের বিদ্যুতের দমকা আলো আর ইটের দেয়াল সব কেড়ে নিয়েছে। পুরো জীবনযাপনটা অনেকটাই যেন বস্তির মতো- গাদাগাদি করে একসঙ্গে বেঁচে থাকা। ওখানে জীবন আছে, যাপনটুকুই হারিয়ে গেছে। তারপর আর মামাবাড়ি যাওয়া হয়নি।
গত ৪০ বছরে বাংলাদেশের শহর যেমন পাল্টে গেছে, তেমনি অনেক গ্রামও বদলে গেছে। ঢাকার এই ধানমন্ডিতে থাকার যে মুগ্ধতা ছিল, সেটা এখন প্রায় বস্তির মতো মনে হয়। স্কুলজীবনে যেই ময়মনসিংহ শহরে সাইকেল নিয়ে পুরো শহর ঘুরে বেড়িয়েছি, সেই ময়মনসিংহের মায়া কেড়ে নিয়েছে অসংখ্য ছোট ছোট খুপরির ঘর। সবকিছু কেমন যেন গলা চেপে ধরেছে। মানুষ আর মানুষ - কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এই অসংখ্য মানুষের মিছিল! সেই মৃত শহরে এখন আর যেতে ইচ্ছে করে না।
তবে এর সবকিছু খারাপ নয়। উন্নয়নের ছোঁয়া গ্রামেও পৌঁছেছে। এক বাড়িতে ৫টি বাড়ি যেমন তৈরি হয়েছে, পাশাপাশি নাগরিক অনেক সুবিধাও সেখানে গিয়ে জায়গা নিয়েছে। বিদ্যুৎ গিয়েছে, ঘরের ভেতর টয়লেট হয়েছে, কোথাও ট্যাপের পানিও পাওয়া যায়, ঘরের ভেতর টিভি এসেছে, ফ্রিজ এসেছে, রাইস কুকার, আয়রন, কোথাও কোথাও এয়ারকন্ডিশনার।
সমগ্র পৃথিবীতেই উন্নয়নের অর্থ হলো এসব নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেয়া। উন্নত দেশে মানুষ পরিবার নিয়ে গ্রামে থাকতে পছন্দ করে। কারণ সেই গ্রামের ভেতর তার যাবতীয় নাগরিক সুবিধা থাকে। (ইদানীং আমারও ইচ্ছে করছে, তেমন কোনো একটা গ্রামে গিয়ে খোলা জায়গায় বাকি জীবনটা থাকি।) বাংলাদেশের গ্রামগুলোতেও সেই ছোঁয়া লেগেছে। সেই কারণে দেখবেন দেশে অনেক ইলেকট্রনিক্স পণ্য তৈরি হচ্ছে এখন। সেগুলো মানুষ অ্যাফোর্ড করতে পারছে। পাশাপাশি মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেট তো গিয়েছেই।
বাংলাদেশের এই উন্নয়ন কিন্তু বাস্তবতা। সেই খুব রিমোট গ্রামেও ইন্টারনেট আছে। হয়তো গতি খুব ভালো নয়। কিন্তু সেই মানুষটি ওখানে বসে ইউটিউবে ভিডিও দেখতে পাচ্ছে; নয়তো তার পরিবারের প্রবাসী মানুষটির সঙ্গে ভিডিও কল করতে পারছে। (আমার মনে আছে, আমি যখন নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে এগুলো নিয়ে লিখতাম, মানুষ তখন মনে করত আমি বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লিখছি)। কিন্তু বিগত ২০-২৫ বছরে এগুলো মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে।
আমি হয়তো আমার মামাবাড়ি হারিয়েছি। কিন্তু নতুন প্রজন্মের আরেকটি মানুষ তার নতুন মামাবাড়ি খুঁজে পেয়েছে।
চার.
বাংলাদেশের অর্থনীতি পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলেছে। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ যে খুবই ভালো করছে, তার কিছু সংখ্যা এখানে দেয়া যেতে পারে। করোনার এই দুঃসময়েও বাংলাদেশ তার জিডিপি গ্রোথ ৫.২৪ ভাগ, যা বিগত ১২ বছরে সবচেয়ে নিচে। অর্থাৎ ১২ বছর ধরে সেটা ছিল পাগলা ঘোড়ার মতো- ৭-৮ ভাগ। এই কঠিন সময়ে এসে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২,০৬৪ ডলার, যেখানে গত বছর ছিল ১৯০৯ ডলার।
বাংলাদেশের অর্থনীতি উপমহাদেশের অন্য দুটি দেশ পাকিস্তান এবং ভারত থেকে ভালো করছে। বাংলাদেশ অনেক আগেই পাকিস্তান থেকে ভালো করছিল। সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্নয়নের মাত্রায় ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে। আইএমএফের তথ্যমতে, ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের পার ক্যাপিটাল জিডিপির ৪% বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে ১৮৮৮ ডলার, যেখানে ভারতের পার ক্যাপিটাল জিডিপি ১০.৫% কমে চলে আসবে ১৮৭৭ ডলারে। এর ফলে ভারত হয়ে যাবে দক্ষিণ এশিয়ার তৃতীয় দরিদ্র দেশ। তার নিচেই থাকছে পাকিস্তান এবং নেপাল। বাংলাদেশ, ভুটান, শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপ ভারত থেকে এগিয়ে থাকবে। অথচ মাত্র ৫ বছর আগেই ভারতের পার ক্যাপিটাল জিডিপি ছিল বাংলাদেশের চেয়ে ৪০% বেশি।
পাশাপাশি গত বছর পর্যন্ত বাংলাদেশের পার ক্যাপিটাল ঋণ ছিল ৪৩৪ ডলার, যেখানে পাকিস্তানের সেই ঋণ দ্বিগুণের বেশি (৯৭৪ ডলার)। বর্তমানে বাংলাদেশের ফরেন রিজার্ভ পাকিস্তানের তুলনায় ৫ গুণ বেশি। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, ২০২১ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি হবে ৩২২ বিলিয়ন ডলারের। এর সাদামাটা অর্থ দাঁড়ায়, গড়ে বাংলাদেশের মানুষ এখন পাকিস্তানের মানুষের চেয়ে ধনী।