মার্কিন সমাজে অসাম্য আর বর্ণবাদ
কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডকে মেরে ফেলা যত সহজ ছিল, মৃত্যুপরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেয়া ততই কঠিন হয়ে পড়ছে আমেরিকার জন্য। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু রাতারাতি বদলে দিয়েছে করোনাআক্রান্ত নিস্তব্ধ আমেরিকাকে। পণ্য কিনে একটি ২০ ডলারের জাল নোট দেয়ার অভিযোগে একজনকে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলা যায় যে সমাজে, সে সমাজে ভণ্ডামি ছাড়া আর কী থাকতে পারে, ভাবা যায় না, যদিও মার্কিনিরা সারাবিশ্বে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রফতানি করে।
৪৬ বছরের জর্জ ফ্লয়েড একটা দোকান থেকে সিগারেট কিনেছিল। দোকানের অভিযোগ, ফ্লয়েড ২০ ডলারের একটা জাল নোট দিয়েছিল। কিন্তু ফ্লয়েড পালিয়ে যায়নি। দোকানের বাইরে বসেছিল নিজের গাড়িতে বসে। জাল নোট দেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করলে দোকানদার পুলিশ ডেকে আনে। মুহূর্তে পুলিশ ছুটে আসে। উত্তেজিত শ্বেতাঙ্গ পুলিশকর্তা ডেরেক শভিন। ফ্লয়েড অপরাধী, এমন কোনো তথ্য পুলিশের কাছে ছিল না। তার কাছে কোনো অস্ত্রও ছিল না।
ফ্লয়েড হিংস্র কোনো আচরণও করেনি। তবুও সেই পুলিশ সদস্য ফ্লয়েডকে গাড়ি থেকে টেনে বের করে, তাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে, নৃশংসের মতো তার ঘাড় নিজের হাঁটু দিয়ে সজোরে চেপে ধরে। সেই চাপ বাড়তেই থাকে। দম বন্ধ হয়ে আসে। ফ্লয়েড শেষ মুহূর্তে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘আই কান্ট ব্রিদ’। মারা যায় ফ্লয়েড।
শ্বাস নেয়ার এই করুণ আকুতি দেখে, ভয়ংকর খুনের দৃশ্য দেখে, করোনায় বিপর্যস্ত আমেরিকায় আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ মানুষ। সামাজিক আর শারীরিক দূরত্বের শৃঙ্খল ভেঙে মানুষ পথে নেমে আসে। করোনার থাবায় এক লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে আমেরিকায়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প করোনা মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে সারা বিশ্বে প্রথম হয়েছেন বাজে স্বাস্থ্য অব্যবস্থাপনায়।
এর ওপর তার চার বছরের শাসনামলে বর্ণবিদ্বেষ, অর্থনৈতিক মন্দা, প্রবল বেকারত্ব যেন পরিস্থিতিকে আরও অগ্নিগর্ভ করে তোলে। সব মার্কিন নাগরিক যেন একযোগে বলছে, তারা আর শ্বাস নিতে পারছে না, তাদের দম আটকে আছে। এই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে টরেন্টো, লন্ডন, প্যারিস, স্টকহোম হয়ে পুরো পশ্চিমা বিশ্বে। মানুষ নেমেছে নির্যাতন, বর্ণবাদ আর অসাম্যের বিরুদ্ধে।
মিনিয়াপলিসে ফ্লয়েডের জন্য শোকসভায় দাঁড়িয়ে সিভিল রাইটস নেতা রেভ আল শার্পটন বলেছেন, ‘সে একজন মানুষ ছিল, তার স্বপ্নের একটি পরিবার ছিল। পুলিশ সদস্যের উচিত ছিল মানুষের মানবিক মর্যাদা বোঝা, জীবনের মূল্য বুঝতে পারা। মার্কিন সমাজ সেটি বুঝতে পারছে না বলেই পরিস্থিতি এতটা অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে।’ সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেছে ফ্লয়েডের ছয় বছরের কন্যা জিয়ানা। বলেছে, ‘আমার বাবা তো দুনিয়াই বদলে দিল’।
কিন্তু মার্কিন সমাজ কতটা বদলাবে, ট্রাম্পই বা কতটা বল প্রয়োগের পরিবর্তে সমঝোতার পথে চলবেন, সেটি বড় বিতর্ক। প্রতিবাদে ফুঁসছে আমেরিকা। কারফিউ-মোড়া দেশের প্রায় সব বড় শহর সাক্ষী থেকেছে বিক্ষোভের। চলেছে ধরপাকড়, সংঘর্ষ। ন্যাশনাল গার্ড নেমেছিল আগেই। বিক্ষোভ ঠেকাতে সেনা নামানোর হুমকিও দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সহিষ্ণুতা এবং মুক্তদৃষ্টির কথা বললেও ট্রাম্প বারবার কথা বলেছেন ক্ষমতার ভাষাতেই।
বৈষম্যের শিকার কালো বা বাদামি মানুষ নয়, অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত আমেরিকার সব বর্ণের মানুষ নেমেছে রাজপথে। ভাঙচুর আর লুটপাটের যে দৃশ্য দেখা গেল, তা একটা দেশের সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের বড় বড় আবিষ্কারের পর ইউরোপীয় ও মার্কিন সমাজে গণতন্ত্র যেমন বিকশিত হয়েছে, তেমনি পুঁজিও তার ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে। বড় বড় পুঁজিপতির সৃষ্টি হয়েছে, অর্থনৈতিকভাবে এই দেশগুলো সমৃদ্ধ হয়েছে। কিন্তু তাই বলে সেখানকার শ্রমিক শ্রেণি ও অতি সাধারণ মানুষের ভাগ্যের যে খুব পরিবর্তন হয়েছে, সেটা বলা যাবে না।