ছবি সংগৃহীত

হাতবদলে আলুর দাম ৫ গুণ! (যায়যায়দিন)

priyo.com
লেখক
প্রকাশিত: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, ০৩:৪৪
আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, ০৩:৪৪

প্রান্তিক পর্যায়ে আলুর দাম কম থাকায় খরচই উঠছে না চাষিদের। প্রতি কেজি আলু উৎপাদনের পেছনে ১০ টাকার বেশি খরচ হলেও ২ টাকায় কেনার মতো পাইকার পাচ্ছেন না তারা। তবে চাষিরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আখের গোছাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। ২-৩ টাকায় মাঠ থেকে কেনা আলু রাজধানীসহ দেশজুড়ে বিক্রি হচ্ছে ১০-১২ টাকায়। শুধুমাত্র হাতবদলেই দাম বাড়ছে ৫ গুণ। জানা গেছে, আলুর দাম না পাওয়ায় দেশের বিভিন্ন জেলার কৃষকরা রাস্তায় নেমে আসে। দাম বাড়ানোর দাবিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন তারা। ঘাম ঝরানো ফসল রাস্তায় ফেলে দিয়ে জানায় অভিনব প্রতিবাদ। কৃষকের প্রতিবাদের খবরে যখন উদ্বিগ্ন কৃষিমন্ত্রী জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে কৃষককে আলু সংরক্ষণ করার পরামর্শ দিয়েছেন তখন ঢাকার বাজারে ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। মাঠ থেকে আসার পর আলু কয়েক হাত ঘুরে ৫-৬ গুণ দামে বিক্রি হচ্ছে বাজারে। কৃষক দাম না পেলেও ক্রেতাদের পকেট থেকে যাচ্ছে ৫ গুণ। এ বিষয়ে পাইকারি, খুচরা ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা ভিন্ন ভিন্ন কথা বলছেন। অনুসন্ধানে আলুর এই দাম বাড়ার পেছনের নানা তথ্য বেরিয়ে এসেছে। জানা গেছে, কৃষকের উৎপাদিত আলু ব্যাপারী (যিনি আলু কিনে ঢাকায় আনেন), আড়তদার, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা হয়ে ক্রেতার কাছে গিয়ে পেঁৗছায়। এই চার হাতবদলের পর মাঠের ২ টাকার আলু রাজধানীর বাজারে হয়ে যাচ্ছে ১০-১২ টাকা। দাম বাড়ার সমীকরণে দেখা যায়, ২ টাকার আলু ব্যাপারী আড়তদারের কাছে বিক্রি করছে ৫ টাকায়, আড়তদার পাইকারের কাছে বিক্রি করছে ৭ টাকায়, পাইকার থেকে খুচরা বিক্রেতারা কিনছেন ৮ থেকে সাড়ে ৮ টাকা দামে। আর সবার লাভ নিজের পকেট থেকে দিয়ে সাধারণ ক্রেতাদের তা কিনতে হচ্ছে ১০-১২ টাকা দামে। সরেজমিন বাজার ঘুরে জানা গেছে, খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১২ টাকায়। কিন্তু আলু ব্যাপারী অথবা আড়তদাররা এই আলু মাঠ থেকে কিনে আনছেন ২ থেকে ৩ টাকায়। রাজধানীর আলু বাজারগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। তারা মাঠ থেকে আনার পর দাম বাড়িয়ে দেন। এদের কাছে অসহায় পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা। পাইকারি ও খুচরা আলু ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, আড়তদাররা মাঠ থেকে আলু কিনে এনে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। যার কারণে বাজারে আলুর দাম বাড়তি। তারা আরো বলছেন, অনেক সময় সব আড়তদার এক হয়ে দাম বাড়াচ্ছেন। তখন তাদের আর কিছু করার থাকছে না। একই কারণে মানে খারাপ আলুও তাদের বেশি দামে কিনতে হয়। আলুর বাড়তি দাম প্রসঙ্গে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের (নতুন কাঁচাবাজার) পাইকারি ব্যবসায়ী আব্দুল জলিল বলেন, দুর্নীতিটা করছে আড়তদাররা। আর পাইকারি ও খুচরা বাজারে এর প্রভাব পড়ছে। তিনি জানান, আড়তদারদের কাছ থেকে ৭ টাকা দরে আলু কিনে বিক্রি করছেন ৮ টাকায়। এ সংক্রান্ত একটি রসিদও এই প্রতিবেদককে দেখান তিনি। তবে বাজারে আলুর বাড়তি দাম প্রসঙ্গে একই বাজারের চাঁদপুর বাণিজ্যালয়ের আড়তদার মিজানুর রহমান বলেন, খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। পরিবহন ভাড়া বেশি। তাই মাঠ থেকে আসার পর আলুর দাম কয়েকগুণ হয়ে যাচ্ছে। মাঠ থেকে কত টাকা দরে আলু কিনেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এই আলু তারা কেনেন না। মাঠ থেকে ব্যাপারীরা (মাঠ থেকে যিনি কিনেন) আলু কিনে ট্রাকযোগে আড়তে নিয়ে আসেন। আড়তদাররা শুধু বিক্রি করে দেয়। তিনি জানান, মাঠ থেকে প্রতি কেজি গোলআলু ২ টাকায় ও ডায়মন্ড আলু ৫ টাকা দরে কিনে ঢাকায় আনা হয়। এরপর আড়তদাররা গোলআলু ৪ থেকে সাড়ে ৪ টাকা ও ডায়মন্ড আলু ৭ টাকা দরে বিক্রি করেন। মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট ও কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, তারা প্রতি কেজি ডায়মন্ড আলু ৯ টাকা ও গোলআলু ৮ টাকা দরে বিক্রি করছেন। এদিকে আলু ব্যাপারীরা বলছেন, মাঠ থেকে কম দামে আলু কিনলেও তার পেছনে অনেক খরচ হয়ে যায়। পরিবহন খরচ, শ্রমিকের মজুরি, সংরক্ষণ খরচসহ প্রতি কেজি আলুর দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। রাজধানীতে দেশের উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁও থেকে আলু সরবরাহকারী রহিম উদ্দিন মিয়া জানান, ঠাকুরগাঁও থেকে এক ট্রাক আলু ঢাকায় পেঁৗছতে ২৬ থেকে ২৮ হাজার টাকা লাগে। প্রতি ট্রাকে ১৪ টন আলু ঢাকায় আসে। এক্ষেত্রে প্রতি কেজি আলুর জন্য পরিবহন খরচ পড়ে ২ টাকা। সবার লাভ হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষক। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার কাদিপুর এলাকার কৃষক আজমল হক গত মৌসুমে ৮ বিঘা জমিতে আলু চাষ করে লোকসানের মুখে পড়েন। প্রতি বস্তা আলু (৮৪ কেজি) উৎপাদনে খরচ হয়েছিল ১ হাজার ৭৫ টাকা। পরে আলুর দাম ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় কেনার কেউ ছিল না। প্রতি বস্তায় ৮২৫ থেকে ৮৫০ টাকা লোকসান গুনতে হয়। এর মধ্যে ২০০ বস্তা আলু হিমাগারে রাখা আছে। সেই লোকসান মাথায় নিয়ে আজমল হক এবার আবার ৫ বিঘা জমিতে আলু আবাদ করেন। এবারো ক্ষতির মুখে পড়েছেন তিনি। আজমল হকের মতো দেশের অধিকাংশ চাষিই টানা দুই মৌসুমে লোকসানের মুখে পড়েন। ঠাকুরগাঁওয়ের রাজাগাঁও ইউনিয়নের আলুচাষি হুমায়ুন কবির জানান, ডায়মন্ড আলুর জন্য তারা ৪ টাকা ও গোলআলুর ক্ষেত্রে দেড় থেকে ২ টাকা দাম পাচ্ছেন। আলুর দাম নিয়ে তারসহ ওই অঞ্চলের কৃষকের মধ্যে ব্যাপক অসন্তুষ্টি রয়েছে। জেলার আরেক কৃষক আবদুল মালেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার আলু চাষে প্রতি বিঘায় তার খরচ হয়েছে প্রায় ত্রিশ হাজার টাকা। এক বিঘায় তার ৮০ মণ আলু হয়েছে। কিন্তু বর্তমান বাজারে এর দাম হলো ৭ হাজার টাকার মতো। এতে আবাদের খরচ উঠবে না।