অলংকার ব্যবহারের ইতিহাস পূর্ণাঙ্গভাবে জানা না গেলেও এটা স্বীকৃত যে, অলংকারের উদ্ভব ও ব্যবহার মানব ইতিহাসের গোড়া থেকেই শুরু হয়েছে। সৌন্দর্যবোধের পাশাপাশি মানুষরা তাদের নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদে নানা অলৌকিক বিশ্বাস ও সংস্কার থেকে বিভিন্ন ধরনের অলংকার ব্যবহার করে আসছে। যেমন -
মানবসমাজের প্রাথমিক পর্যায়ের একটি বিশ্বাস ছিল, শত্রু হত্যা করে শত্রুর হাড়, মস্তক নিজ দেহে ধারণ করলে শত্রুর শক্তি ও কৌশল ধারণকারীর আয়ত্তে এসে যায়। এ বিশ্বাস থেকেই শত্রু, অর্থাত্ হিংস্র জীবজন্তু থেকে মানুষ পর্যন্ত হত্যা করে তার হাড়, দাঁত, মস্তক ইত্যাদির মালা গেঁথে পরা হতো। পৃথিবীর বহু জাতির মধ্যে এ ধরনের প্রথার কথা জানা যায়। যেমন - সোশান জাতির মধ্যে বড় ভালুক মেরে তার নখ পরতে পারা অত্যন্ত গৌরবের বিষয়, আন্টাসিবাসীরা শত্রুর দাঁত ও অন্যান্য অস্থি অলংকার হিসেবে পরিধান করে, কারিব জাতি শত্রুর দাঁত মালা গেঁথে পরে!

টুপি জাতির লোকরা বন্দির মাংস খেয়ে তার দাঁতের মালা তৈরি করে গলায় পরে। এমনকি মকস রমণীরাও স্বামী কর্তৃক যুদ্ধে নিহত শত্রুর দাঁত গেঁথে অলংকার তৈরি করে পরে।
উপরি রোগশোক থেকে শিশুকে রক্ষার জন্য শিশুর গলায় বা কোমরে কড়ি, শঙ্খ অথবা সামুদ্রিক মাছের আঁইশের মালা পরিয়ে দেয়া হয়। কোনো কোনো এলাকায় শিশুর গলায় তামা, সিসা বা লোহা অথবা পোড়ামাটির চাকতি পরানো হয়।
আংটি ব্যবহারের পেছনেও কাজ করে নানা বিশ্বাস। অনেকে এই বিশ্বাসের কারণেই বিভিন্ন ধরনের পাথরের আংটি পরে থাকেন। অনেকে বালা-মুসিবত দূর করার জন্য আংটি পরেন। কেউ কেউ ধন-দৌলত বৃদ্ধি করার আশায় আংটি পরেন। স্বাস্থ্য ভালো রাখার উদ্দেশ্যে, মনোবাসনা পূর্ণ হওয়ার আশায় ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে মানুষ রত্নসম্বলিত আংটি পরে। বাত ব্যথা দূর হবে এই ভরসায় অনেক মানুষই আঙুলে সপ্তধাতুর আংটি পরে থাকেন।
প্রাচীন মিশরে অলংকারের সাথে জাদুবিদ্যা বা মোহিনীবিদ্যার সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করা হতো। এ কারণেই মিশরীয়দের প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহৃত অলংকার মৃত্যুর পর তাদের কবরে দিয়ে দেয়া হতো। ফেল্ডস্পারের সবুজ রং ও নীলকান্তমণির রংকে মিশরবাসী নবজীবনের রং বলে মনে করত। রত্নের রক্তাভ লাল ও নীল রংকে তারা মনে করত বেহেস্তের রং। কড়ি এবং মাছের আকৃতিকে রক্ষাকবচ এবং গুবরে পোকার আকৃতিকে সকল বিষয়ের মহাশক্তি বলে বিশ্বাস করত তারা। ফারাওয়ের কবর থেকে পাওয়া গুবরে পোকার আকৃতির নীলকান্তমণি ও অলংকারে গুবরে পোকার অলংকরণ এ কথারই সাক্ষ্য দেয়। বেদুইনরা পূর্ণচন্দ্রের নকশার অলংকারকে ভালবাসার রাতের প্রতীক হিসেবে বিশ্বাস করে। তাই বিয়ের অলংকারে দেখা যায় এই নকশার অলংকারের প্রাধান্য। আবার চিকন অর্ধচাঁদকে ইসলামের নিদর্শন হিসেবে গুরুত্ব দেয় তারা।

আফগানিস্তানের Turko-man জাতি অলংকারের ঝংকার বা ঘুঙুরের শব্দকে অশুভ শক্তির প্রতিরোধক বলে মনে করে। তাই অশুভ শক্তি থেকে নিজেদের রক্ষা করতে তারা প্রায় সব অলংকারেই ঘুঙুর ব্যবহার করে।
অতীতের মতো এখনো নানা বিশ্বাস ও সংস্কার থেকে বিভিন্ন ধরনের অলংকার পরার প্রথা প্রচলিত আছে। বিবাহিত নারীরাও এর বহির্ভূত নন! বিশ্বাস করা হয়, বিবাহিতা নারীর অলংকারহীন নাকের নিঃশ্বাস স্বামীর আয়ু কমে যায়! এটাও বলা হয়, বিবাহিতা নারী হাতে অলংকার না পরলে স্বামীর অমঙ্গল হয়, এমনকি সে নারী শীঘ্রই বিধবা হয়; আবার স্ত্রীর খালি হাত, অর্থাত্ অলংকারহীন হাত দেখে স্বামী কাজে গেলে সে কাজ সম্পন্ন হয় না। এ কথাও প্রচলিত রয়েছে, বিবাহিতা নারীর গায়ের অলংকার এমনিতেই খসে গেলে বা হারিয়ে গেলে তার স্বামীর অমঙ্গল হয় বা স্বামী মারা যায়!
শিশুদের সুরক্ষার বিষয়েও বেশ কিছু বিশ্বাস রয়েছে যা এখনো মানা হয়। অপদেবতার কুদৃষ্টি থেকে শিশুকে রক্ষার জন্য তার কানে ছিদ্র করে ধাতুর রিং পরিয়ে দেয়া হয়। আবার কোথাও কোথাও অপদেবতা বা মানুষের কুদৃষ্টি থেকেও শিশুকে রক্ষা করার জন্য শিশুর কোমরে চোখবিছা পরানো হয়।

বিভিন্ন জীবজন্তু বিষয়ক সংস্কার ও বিশ্বাস থেকেও পরা হয় অদ্ভুত কিছু অলংকার। যেমন - বাঘ, সাপ ও কুমির থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাঘের দাঁত, কুমিরের দাঁত, হাড় ও নখের এবং সাপের হাড়ের তৈরি মালা, মাদুলি ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। সুন্দরবন এলাকার নানা পেশাজীবী মানুষদের মধ্যে এই বিশ্বাসগুলো প্রচলিত আছে। তারা সাপের কাপড় থেকে বাঁচার জন্য গরুর খুরের তৈরি মাদুলি এবং মৌমাছির কামড় থেকে বাঁচার জন্য লোহার তৈরি মাদুলি পরে।
এছাড়া অলংকারের নকশা বিষয়ক কিছু বিশ্বাসও প্রচলিত রয়েছে পৃথিবীর নানান দেশে। যেমন - প্রেমে সাফল্য পাওয়ার জন্য গ্রিসের মেয়েরা প্রেমের দেবতার সমন্বয়ে তৈরি কানের দুল পরে, ওমানে নেকলেসকে উর্বরতার প্রতীক বলে মনে করা হয়, আরব বেদুইনর তারের প্যাঁচানো সাপের মতো অলংকারকে রক্ষাকবচ বলে মনে করে ইত্যাদি।
বলা হয়, বিশ্বাসেই মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর! বিশ্বাস করে ব্যবহার করা হয় বলেই অনেক অলংকার বর্তমানে আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। বিশ্বাসের কারণেই মানুষ এই আধুনিক যুগেও রোগশোক ও বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাবিজ, কবচ, মন্ত্রপূত সুতা, বাজু, কড়া, মাদুলি পরে থাকে!