
ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে ৭৬ রানে আউট হওয়ার পর কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়ছেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। ছবি: সংগৃহীত
চম্পাবতের বাঘিনী, জিম করবেট ও একজন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ
আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০১৮, ২১:২৩
(প্রিয়.কম) আহ্! আর একটু যদি লড়তে পারতাম। ছবিতে ব্যর্থতা আর হতাশার এমন রূপই ধরা পড়ল মাহমুদউল্লাহর অভিব্যক্তিতে। আদতে তিনি কাঁদছেন। ২৫ হাজার দর্শকের সামনে কান্নাটা দেখে ফেললে কি কেলেঙ্কারিই না হবে! তাই লুকিয়ে রাখার চেষ্টা। অবশ্য মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ বরাবরই লুকিয়ে থাকেন। বলা যায়, লুকিয়ে রাখা হয় তাকে। পর্দার আড়ালের নায়ক তিনি। ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে অনেকক্ষণ টেনেছিলেন পুরো দলকে। কিন্তু শেষতক ব্যর্থ হলেন। দিনশেষে তিনি জিম করবেট হয়ে থাকলেন, যিনি শিকারি মানুষখেকো বাঘ মারেন। আর লড়ে যান চম্পাবতের আহত বাঘিনীর মতো।
১.
নেপালের হিমালয় এলাকার ঘটোনা। একবার এক বাঘিনীর অত্যাচারে মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। ত্রাসের মতো ঘুরে বেড়ায়, আর এমন চালাকি করে মানুষ মারে যেন মনে হয় যমদূত! কিন্তু ওই যে, বাঘ তখনই মানুষ খায় যখন বুড়ো কিংবা আহত হয়ে শিকারের অযোগ্য হয়ে ওঠে। হয়েছিলও তাই। কোনো এক পাজি আনাড়ি শিকারি বাঘিনীকে গুলি করেছিল। তাতেই আহত হয় সে। এরপর থেকে যা হওয়ার তাই হলো। মানুষ দেখলেই তেড়ে যেত, রেগে যেত, হামলে পড়ত। স্বাভাবিক শিকার করতে না পারায় মানুষ শিকার করা সুবিধা ছিল তার জন্য। সেটা করতে গিয়ে পুরো জনপদে হাপিত্যেশ ফেলে দিল। ওই সময়ের সংবাদপত্রে খবর হয়েছিল, বাঘিনী নাকি প্রায় ২০০ মানুষ মেরেছে! তাই তাকে মারতেও উঠেপড়ে লাগে সবাই। কত কিছুই না হলো, জনে জনে শিকারি এলো, ফাঁদ পাতা হলো; কিন্তু সব ব্যর্থ। ধূর্ত বাঘিনী যেন মানুষ খেয়ে মানুষের মতোই চালাক হয়ে গেল। না পেরে নেপালের রাজা সেনাবাহিনী পর্যন্ত পাঠিয়ে দিলেন বাঘ মারতে। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের নিরাপত্তারক্ষীরাও এই বাঘকে শিকার করতে পারেননি। মাঝখান দিয়ে ভারতে পালিয়ে এলো বাঘিনী। হয়ে পড়ল আর বেশি চালাক!
জিম করবেট ও চম্পাবতের বাঘিনী। ছবি: সংগৃহীত
আগে সে মানুষ শিকার করত শুধু রাতের বেলা। ভারতের বনে এসে দিনের বেলাতেও আক্রমণ করা শুরু করল। সঙ্গে যোগ হলো গরু, ছাগল, মহিষ তুলে নিয়ে যাওয়ার অভ্যেস। ভারতের রাজ্য সরকারও চিন্তিত হয়ে গেল। সব ওষুধে যখন ব্যর্থ, তখন যথারীতি ডাক পড়ল জিম করবেটের। চিঠি পেয়ে গাঁইগুঁই করে এলেন জিম করবেট। সরকারি আদেশে করবেট ভারতে পৌঁছানোর দিনই একটি ছোট্ট মেয়েকে আক্রমণ করে বসল বাঘিনী। পিছু নিলেন তিনি। রক্তের দাগ দেখে এগোতে থাকলেন বিখ্যাত শিকারি। তারপর মুখোমুখি। জিমের সাহস দেখে ঘাবড়ে গেল বাঘ। আক্রমণের সুযোগই দিলেন না। সব মিলিয়ে ৪৩৬ জন মানুষ হত্যা করে করবেটের বন্দুকের সামনে কুপোকাত হলো বাঘিনী, চম্পাবতের বাঘিনী।
২.
২০০৭, জাতীয় দলে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের অভিষেক ম্যাচ। কলম্বোয় বাংলাদেশকে ১৯৮ রানের লক্ষ্য ছুড়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। জবাবে ৬৫ রান তুলতেই ৫ উইকেট হারিয়েছে সফরকারীরা। ভয়, ১০০ রানের নিচেই না গুটিয়ে যান তামিম ইকবাল-মুশফিকুর রহিমরা। সেখান থেকে টেনে তোলার চেষ্টা মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের। অষ্টম উইকেটে যখন আউট হলেন, তখন বাংলাদেশের মোট রান ১৫১। দুর্যোগের সময় ৫৪ বল খেলে ৩৬ রান তুললেন।
২০১০, প্রতিপক্ষ ভারত। ৫০ ওভারে বাংলাদেশের মোট সংগ্রহ ২৪৭ রানে। ওই ম্যাচে ৯৫ রানে ৫ উইকেট হারায় সাকিব আল হাসান-মোহাম্মদ আশরাফুলরা। মাহমুদউল্লাহ ৬৪ রানে অপরাজিত ছিলেন।
উদযাপনে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। ফাইল ছবি: এএফপি
২০১১ সালে বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যাট করতে নেমে ম্যাচ জিতিয়ে ফিরেছিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। ৫ উইকেট হারিয়ে ১৬২ রানের মাথায় মাঠে নামেন তিনি। হাতে ছিল মাত্র ২টি উইকেট। প্রয়োজন ছিল ১৬৯ রান। শেষ পর্যন্ত ওই ২ উইকেট হাতে রেখেই ম্যাচ নিজেদের করে নিয়েছিলেন রিয়াদ।
প্রতিপক্ষ উইন্ডিজ। ২০১১ সালে তাদের বিপক্ষে ব্যাট করতে নেমে ১৩ রানের মাথায় ৫ উইকেট হারিয়ে বসে বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যানরা যখন সমূলে ব্যর্থ তখন হাল ধরলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। টেনে নিয়ে গেলেন ১৩৬ রান পর্যন্ত। দলীয় রানটা আরও বড় করতে পারতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আরেকজন মাহমুদউল্লাহর অভাবে সেটা পেরে ওঠেননি তিনি। ৫৬ রানে অপরাজিত থেকে হারের যন্ত্রণা নিয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন।
২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপ। প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৮ রান ২ উইকেট হারিয়ে চাপে বাংলাদেশ। সেখান থেকে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের সেঞ্চুরিতে উঠে দাঁড়াল মাশরাফি বিন মুর্তজার দল। সঙ্গে মুশফিকুর রহিমের ৮৯ রানের ইনিংসে মোট রান দাঁড়াল ২৭৫। ম্যাচটিতে ১৫ রানে জয় পায় বাংলাদেশ।
একই আসরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও সেঞ্চুরি করেন মাহমুদউল্লাহ। ১২৮ রানের ইনিংস খেলেন। কিন্তু দল জেতেনি। ২৮৯ রানের লক্ষ্য ছুড়ে দিলেও ৩ উইকেটে জয় পায় ব্ল্যাক ক্যাপরা।
আউটফিল্ডের সঙ্গে উইকেটকে খালি চোখে আলাদা করা যায় না। একে তো সবুজ ঘাস, সাথে ভেজা আবহাওয়া। সব মিলিয়ে ডাবলিনের মালাহাইডে ব্যাটসম্যানদের জন্য সাক্ষাৎ মৃত্যুকূপ তৈরি করেছিল আয়ারল্যান্ড। তারপরও অপরাজিত ৬৪ রানের ইনিংস খেললেন তামিম ইকবাল। প্রশংসায় ভাসছেন তিনি। কিন্তু এবারও এড়িয়ে গেল মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ৪৩ রানের ইনিংসটি। ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আগে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে এবারও পর্দার আড়ালে মাহমুদউল্লাহ।
চ্যাম্পিয়ন ট্রফি। প্রথমবারের মতো এই আসরে সুযোগ পেয়েই কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছে যায় বাংলাদেশ। এর পিছনে সবচেয়ে বড় প্রভাব ছিল নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে জয়। আর সেই জয়ের অন্যতম কাণ্ডারি মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। খেলেন ১০২ রানের ইনিংস। যদিও আলো কেড়ে নেন সাকিব আল হাসান। ১১৪ রান করে জিতে নেন ম্যাচসেরার পুরস্কার।
পরের গল্পটা সবার জানা। ২০১৮ সালে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে শ্রীলঙ্কা ২২২ রানের লক্ষ্য দিল। প্রথম শিরোপা জয়ের হাতছানি। কিন্তু পেরে উঠল না বাংলাদেশ। একপাশে তামিম-মুশফিকরা যখন ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ। খেলেছিলেন ৭৬ রানের ইনিংস। কিন্তু ম্যাচ জেতাতে পারেননি। কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছেড়েছিলেন।
৩.
চম্পাবতের বাঘিনী, জিম করবেট আর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ-তিনটিই যেন একই সূত্রে গাঁথা। বাঘটি তখনই মানুষখেকো হয়ে উঠেছিল যখন শিকার করার সামর্থ্য হারিয়েছিল। অন্যদিকে জিম করবেটকে তখনই ডাকা হয় যখন সব ফাঁদ আর শিকারিরা ব্যর্থ হন। তারপরও সহজে আসেন না তিনি। কেবল সরকারি আদেশই তার জন্য শিরোধার্য। একই পথের পথিক মাহমুদউল্লাহ। অনেক জয়ের কাণ্ডারি, মান বাঁচানোর সম্বল হয়েও তিনি পর্দার আড়ালে। তার অবদানটুকু যেন পিছনেই পড়ে যায় সব সময়। সে কারণেই ডাকা হয় পর্দার আড়ালের নায়ক কিংবা আনসাং হিরো!
দলের সবাই জ্বলে ওঠার দিন নিষ্প্রভ থাকেন তিনি। কিন্তু ব্যর্থতার দিনেই যেন হেসে ওঠে তার ব্যাট। তাতে খুব একটা সুবিধা হয় না। তারকাখ্যাতি তার ভাগ্যে দুর্মূল্য। বাংলাদেশ জাতীয় দলে তিনি এমনই একজন সদস্য, যে খুব ভালো খেললেও আলোচনায় আসতে পারেন না। অথচ অল্প খারাপ খেললেই সমালোচিত হন।
বেশিরভাগ সময়ই মাহমুদউল্লাহর ইনিংসগুলো সংখ্যার দৌড়ে ছোট হয়। ৩০-৬০ রানের মধ্যে। কিন্তু তিনি যখন ব্যাট করতে নামেন তখন এই ইনিংসগুলোই কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সেটার মোটাদাগে একটা ধারণা দিতেই উপরে বেশ কিছু ইনিংসের কথা লেখা হয়েছে। ঝলমলে নয়, কিন্তু ইনিংসগুলো ঘাম ঝরানো। গেল শনিবার যখন মিরপুরে ৭৬ রান করে ফিরছিলেন, তখন চোখের পানি আটকাতে পারেননি। শুধু লুকানোর চেষ্টা করেছিলেন।
ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে ৭৬ রান করার পর সাজঘরের পথে মাহমুদউল্লাহ। ছবি: প্রিয়.কম
সংবাদ সম্মেলনে তাই মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে আলোচনা। অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার ভাবনাও বাকিদের মতোই। ইশ্, আরেকটা মাহমুদউল্লাহ যদি থাকত দলে! তাহলে ম্যাচটা ঠিক বের করে আনা যেত। আক্ষেপঝরা কণ্ঠে তাই বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক বলছিলেন, ‘আরেক পাশের সাপোর্ট অবশ্যই প্রয়োজন ছিল। রিয়াদ শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হয়েছে। ওই সময় শটস খেলাটা খুব স্বাভাবিক। ৩-৪-৫ থেকে যদি সাপোর্ট পেত তাহলে ওর খেলাটা আরও ডিপে যেত। আমি যখন উইকেট যাই, দেখেছি ও চেষ্টা করছিল। পার্টনার হেল্প না করতে পারলে আসলেই কঠিন।’
এই মাশরাফিই সব সময় আগলে রেখেছেন মাহমুদউল্লাহকে। শ্রীলঙ্কায় যখন বাংলাদেশ নিজেদের শততম টেস্টে মাঠে নামল, তখন বসিয়ে রাখা হলো ৩৫ টেস্টে ১৪টি হাফ সেঞ্চুরি ও একটি সেঞ্চুরির সঙ্গে ১৯৩১ রান ও ৩৯ উইকেট নেওয়া মাহমুদউল্লাহকে। এমনকি দেশেও পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছিল তাকে। বাধা দিয়েছিলেন মাশরাফি। সেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই ‘নায়ক’ হওয়ার সুযোগ সামনে নিয়ে এগোচ্ছেন ‘মাশরাফি ভাইয়ের’ মাহমুদউল্লাহ।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুটি টেস্ট খেলবে বাংলাদেশ। ত্রিদেশীয় সিরিজে ইনজুরির কারণে সেই সিরিজ থেকে ছিটকে গেছেন নতুন টেস্ট অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। সহ-অধিনায়ক রয়েছেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। তাই প্রথা হিসেবে এখন নেতৃত্ব তার কাঁধে। ৩১ জানুয়ারি থেকে অনুষ্ঠেয় চট্টগ্রাম টেস্টে বাংলাদেশের হয়ে টসে নামবেন তিনি। গেল বছর যে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ড্রেসিংরুমে দর্শক হয়ে ছিলেন, সে শ্রীলঙ্কার দলকে রুখতে তিনিই নেতৃত্ব দেবেন।
রূপকথার গল্পের নতুন অধ্যায় খুব জরুরি হয়ে উঠেছে মাহমুদউল্লাহর জন্য। ব্যাট কিংবা বল হাতে নুয়ে পড়া দলকে তুলে ধরার গৌরবান্বিত সুযোগ হাতছাড়া হয়তো করার খুব একটা ইচ্ছে নেই তার। তাই স্বপ্নের বন্ধুর পথে জিম করবেটের পাশে দাঁড়ানোটা যেন সময়ের দাবি।
সরকারি আদেশে, কোটি সমর্থকের আবেদনে...
প্রিয় স্পোর্টস/আজাদ চৌধুরী