
বৃহস্পতিবার দুপুরে সম্মিলিত সাংস্কৃতি জোট আয়োজিত শ্রদ্ধা নিবেদন পর্বে দেশের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। ছবি: প্রিয়.কম
ফুলে ফুলে বিদায় নিলেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী
আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৮, ১৯:১৭
(প্রিয়.কম) ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী, মুক্তিযোদ্ধা ও ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর কন্যা। গত ডিসেম্বরে মাকে সাথে নিয়ে শহীদ মিনারে এসেছিলেন। আজও এলেন। কিন্তু দৃশ্যপট ভিন্ন। আগেরবার বয়সের ভারে ন্যুজ অথচ তেজদীপ্ত মাকে দেখেছিলেন আর আজ নিথর-নিস্তব্ধ মাকে দেখলেন। বসন্তের দিনে মাকে নিয়ে বের হতেন ফুল আর বাহারি রঙ্গে সজ্জিত নগরীকে দেখতেন। আজও দেখলেন প্রিয়নন্দিনী। দেখলেন শত শত মানুষের হাতে নিয়ে আসা এক একটি ফুল কীভাবে মা ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণীকে ঢেকে দিল। শবদেহের পাশে দাঁড়িয়ে যেন তিনি একা হয়ে গেলেন।
এমন এক অভিজ্ঞতার সামনে দাঁড়িয়ে ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী বললেন, ‘মা অসুস্থ ছিলেন বলে মাকে নিয়ে এবারের বসন্ত উৎসবটা করা হল না। সে আক্ষেপ ছিল। কিন্তু আজ দেখুন ফাল্গুন মাসেই কীভাবে ফুলে ফুলে মাকে শ্রদ্ধা জানানো হল। কী আবেগে তাকে স্মরণ করা হল। আমি সকলের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।’

ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণীর মেয়ে ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলছেন। ছবি: প্রিয়.কম
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মায়ের সবদেহে তাকালেন। এদিকে অশ্রুসজল চোখে হাতে ফুল নিয়ে এসে থেমে গেলেন সিরাজগঞ্জ ও পটুয়াখালী থেকে আগত সাত জন বীরাঙ্গনা। একাত্তরে যে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন তারা হয়েছিলেন, একি অভিজ্ঞতা ছিল ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীও। ব্যতিক্রম ছিলেন এতটুকু যে, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী শুধু নিজের জন্য নয় অন্যের জন্য, অন্য বীরাঙ্গনাদের জন্য কাজ করে গেছেন।
এভাবেই তার নিজস্ব ভাষায় বলছিলেন সিরাজগঞ্জ থেকে আসা বীরাঙ্গনা রাহেলা বেওয়া। তার ভাষ্য, ‘দিনের পর দিন তিনি এবং তার মতো অনেকে না খেয়ে ছিলেন, কত যাতনা সহ্য করেছেন তা বলে বোঝাবার মতো নয়। প্রতিনিয়ত এক অদ্ভুত অন্ধকারের নিমজ্জিত থেকে হঠাৎ দেখা মিলে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর, নাসির উদ্দিন ইউসুফ ও হাসান আরিফের মতো মানুষের। আজ যে, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতা পান তাও তাদের জন্যে। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী শারীরিকভাবে পারঙ্গম ছিলেন না তবুও আমৃত্যু লড়ে গেছেন বীরাঙ্গনাদের অধিকার আদায়ের জন্যে, মেহনতী মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য।

ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণীর মৃত্যুতে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি বীরাঙ্গনা রাহেলা বেওয়া। ছবি: প্রিয়.কম
বীরাঙ্গনা রাহেলা বেওয়া বলেন, ‘কোনো বিপদে কারে কমু, যামু কই।’
রাহেলা বেওয়া এদিক সেদিক তাকিয়ে নিজের আবেগকে সামলানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। রাহেলার কান্না বাড়তে থাকে। নিজের ভেতর শূন্যতা খুঁড়ে খুঁড়ে খেতে লাগল। জিজ্ঞাসা হতে লাগল কে এই জায়গাটায় এসে দাঁড়াবে? বলবে রাহেলা বেঁচে থাক, সত্যের জন্যে বেঁচে থাক। রাহেলা কাঁদতেই থাকলেন এসময় ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর মেয়ে রত্নেশ্বরী প্রিয়দর্শিনী,ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী, ছেলে কারু তিতাস, কাজী শাকের তূর্য মাকে নিয়ে যেতে যেতে মাথা ঘুরিয়ে একবার রাহেলার দিকে তাকিয়ে হয়তো মায়ের মুখটেই দেখে নিলেন।
৮ মার্চ, বৃহস্পতিবার দুপুরে সম্মিলিত সাংস্কৃতি জোট আয়োজিত এই শ্রদ্ধা নিবেদন পর্বে দেশের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হয়। এতে তুষ্ট হল তার পরিবার, স্বজন ও সতীর্থরা। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী আর ফিরবেন না, এই সত্য জেনেই চির-গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া হল তাকে। ফুলেশ্বরীর ভাষায়, ‘নানা জায়গায় ঘুরে মা আজ একটা ঠিকানা পেয়ে গেলেন। শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে শহীদ জাহানারা ইমামের পাশেই তিনি শুয়ে থাকবেন। এটাই হবে তার স্থায়ী ঠিকানা’।
প্রিয় সংবাদ/নোমান