
ছবি: প্রিয়.কম
ফেসবুকে প্রতারণার ফাঁদ, টাকা হারাচ্ছেন প্রবাসীরা!
আপডেট: ২২ আগস্ট ২০১৭, ২২:৪১
(প্রিয়.কম) ‘আপনি কী প্রবাসী? বাড়তি উপার্জনের জন্য দেশের বাইরে গেছেন? তাহলে প্রবাস থেকেই দেশে টাকা পাঠান বিকাশের মাধ্যমে। আমরা দিচ্ছি রিসেলার প্যানেল। এই ব্যবসা করে মাসে আপনি অনেক টাকা আয় করতে পারবেন।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এমন একটি বিজ্ঞাপন দেখে এর নিচে থাকা মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করেন কাতারে থাকা শফিক।
পরে শফিক হোয়াটসঅ্যাপে ওই নম্বরে যোগাযোগ করেন। জানতে পারেন ওই ব্যবসায়ীর নাম মিলন, বাড়ি নোয়াখালী। কাতার থেকে এর বেশি কিছু জানা সম্ভব না হওয়ায় শুধু কথার ভিত্তিতে শুরু করে দেন ব্যবসা।
শফিক জানান, প্রথমে মিলন নামের ওই ব্যবসায়ীকে ৩০ হাজার টাকা দেন। এরই প্রেক্ষিতে শফিকের বিকাশ রিসেলার প্যানেলে ৩০ হাজার টাকা যোগ করে দেন মিলন। কাতার থেকে যারা বাড়িতে তাৎক্ষণিক টাকা পাঠাতে চান শফিক তাদের কাছ থেকে প্রতি হাজারে সামান্য কিছু বেশি অর্থ রেখে প্যানেলের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে দেন। এদিকে মিলনের রিসেলার প্যানেল ছিল সয়ংক্রিয়। এতে টাকা পাঠানোর নির্দেশনা পাওয়া মাত্র মেশিন নির্দিষ্ট মোবাইল নম্বরে টাকা পাঠিয়ে দিত।
‘এইভাবেই চলল কয়েক মাস। বাড়তে থাকল তার ব্যবসার পরিধি। রিসেলার প্যানেলে বাড়তে থাকল টাকার পরিমাণ। ফলে মিলনকেও দিত হতো বেশি পরিমাণ অংকের টাকা’, যোগ করেন তিনি।
তবে শফিকের ব্যবসার মোড় ঘুরে যায় ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে। বিশ্বস্ততার সম্পর্কের এক পর্যায়ে তিনি মিলনের কাছে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৮০ হাজার টাকা পাঠান। টাকা পাঠানোর পর মিলনের নম্বরটি আর খোলা পান না শফিক। যা আজ অবধি বন্ধ। কোনোভাবেই আর যোগাযোগ করতে পারেননি তিনি।
শফিক আক্ষেপ করে বলেন, ‘ভাই সেই যে ব্যবসা ছেড়েছি, এখন আর ব্যবসা করি না। এখন আর মানুষকে ভরসা পাই না। ফেসবুকে এমন অনেক আইডি দেখি যারা বিকাশ এর মাধ্যমে টাকা পাঠানোর রিসেলার দিয়ে থাকে। কিন্তু বাড়তি লাভের আসায় আর ওই পথে হাঁটিনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘শুধু আমি না। এমন প্রতারণার শিকার অনেকেই হয়েছেন। বিশেষ করে আমাদের মতো প্রবাসীরা। তাদের লোভ দেখিয়ে অনেক টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এই চক্রগুলো। কিছুদিন লাভের লোভ দেখিয়ে সবশেষ নিঃশ্ব করে দেয় তারা।’
শুধু কাতার নয়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অবস্থানকারী বাংলাদেশি প্রবাসীরা এমন প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। এ ধরনের প্রতারণার শিকার হয়েছেন যারা তাদের অনেকে এই ব্যবসা থেকে সরে আসলেও অনেকে আবার নিজেদের লোকজনের মাধ্যমে কোনো ব্যবসায়ীকে চিহ্নিত করে নিশ্চিত হয়ে আবার ব্যবসা করছেন। আবার কেউ অল্প টাকা পরিশোধ করে নিজের কাজের পাশাপাশি এই ব্যবসাও করে যাচ্ছেন।
জামিল নামে দুবাই প্রবাসী একজন জানান, ভাই ভাই বিকাশ রিসেলার নামে একজন রিসেলার ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। এরপর তিনি তার কাছ থেকে বিকাশের রিসেলার নেন এবং ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসা শুরুর কয়েক মাসের মাথায় ভাই ভাই বিকাশ রিসেলার এর ফারুক নামের ওই ব্যক্তি তার ১০ হাজার টাকা নিয়ে উধাও হন।
তিনি বলেন, ‘আমার অল্প টাকা গেছে। তবে আমি আরেকজনকে এই ব্যবসা শিখিয়েছিলাম। সেও ব্যবসা এই ব্যবসা করতো। সে অন্তত ৩৫-৪০ হাজার টাকা ধরা খেয়েছে।’
প্রবাসীরা কী কারণে বিকাশে টাকা পাঠান এমন প্রশ্নের উত্তরে জামিল বলেন, বিদেশ থেকে অল্প টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠাতে গেলে সময়ের পাশাপাশি বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয়। এ ছাড়া তো বাড়তি কিছু অর্থও খরচ হয়। তবে বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে গেলে সহজেই টাকা পাঠাতে পারে তারা। ফলে তারা এই মাধ্যমটিকে পছন্দ করছেন এবং ব্যবসায়ীরা বিকাশ রিসেলার মাধ্যমটিকেও গ্রহণ করছেন।
এদিকে ফেসবুকে ইংরেজিতে বিকাশ রিসেলার ও বিকাশ লিখে সার্চ দিয়ে অনেক অ্যাকাউন্টের দেখা মেলে। যারা বাড়তি লোভের স্বপ্ন দেখিয়ে মুখরোচক নানা বিজ্ঞাপন আকারে পোস্ট দিয়ে প্রবাসীদের আকৃষ্ট করেছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তারা হোয়াটসঅ্যাপ বা ইমো নম্বর দেয়। তবে হোয়াটসঅ্যাপে বাংলাদেশি নম্বর দেখলে তারা এ বিষয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনাগ্রহ দেখায়। তবে মধ্য প্রাচ্যের কোনো দেশের প্রবাসী পরিচয় দিলে বা দেশের বাইরের নম্বর হলে তাদের আগ্রহের কমতি থাকে না।
এসব বিষয়ে বিকাশের জনসংযোগ বিভাগের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার জাহিদুল ইসলাম প্রিয়.কমকে জানান, বিকাশের নিবন্ধিত গ্রাহকরা দুটি উপায়ে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স গ্রহণ করতে পারবেন। একটা হচ্ছে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের মাধ্যমে, অন্যটি হচ্ছে ব্র্যাক ব্যাংকের আওতাভুক্ত নির্ধারিত ও অনুমোদিত একচেঞ্জ হাউজ থেকে। তবে কিছু অসাধু ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং চক্র বিদেশে নিজেদের বিকাশ এজেন্ট/রিসেলার পরিচয় দিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অবৈধ মাধ্যম ব্যবহার করে টাকা পাঠাতে প্ররোচিত করছে। বিকাশের সাথে এইসব ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কোনো সম্পর্ক নেই এবং অনুমোদনও নেই।
ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত
তিনি আরও জানান, এইসব অসাধু ব্যাক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়ে আটটি দেশের বাংলাদেশের দূতাবাসে চিঠি দিয়েছে বিকাশ। বিকাশের লোগো যেন কেউ অননুমোদিতভাবে ব্যবহার করতে না পারে সে লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শক্রমে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, বাহরাইন, কুয়েত, ওমান, কাতার, সিঙ্গাপুর এবং মালয়শিয়ায় বাংলাদেশের নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতগণকে সংশ্লিষ্ট দেশের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। এ ছাড়া কেউ যেন অবৈধভাবে বিকাশের লোগো ব্যাবহার করতে না পারে সেইজন্য ওইসব দেশে লোগো নিবন্ধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেন কেউ বিকাশের লোগোর অপব্যবহার করলে আইনগতভাবে মোকাবেলা করা যায়। এজন্য বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য আইনি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যেসব আসাধু ব্যাক্তি এবং প্রতিষ্ঠান অনুমোদনহীনভাবে বিকাশ লোগো ব্যবহার করে প্রতারণা করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনি নোটিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রবাসী বাংলাদেশিদের এই ধরনের প্রতারণা সম্পর্কে সচেতন করতে এবং বৈধ পথে রেমিটেন্স পাঠাতে উৎসাহিত করতে বিকাশ বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকায় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়ার পাশাপাশি নিজস্ব ওয়েবসাইট, ফেসবুক এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে সচেতনতামূলক বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে। এ ছাড়াও বিকাশ নিয়মিতভাবে বিকাশ সন্দেহজনক লেনদেন সংক্রান্ত রিপোর্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের সেন্ট্রাল ফিনান্সিয়াল ইনটিলেজেন্স ইউনিটকে অবহিত করে।
বিকাশ রিসেলারের অনুমোদনের বিষয়ে তিনি জানান, দেশের বাইরে বিকাশের কোনো এজেন্ট বা বুথ নেই এবং বিকাশ রিসেলার বলে কিছু নেই।
ফেসবুক অ্যাকাউন্টগুলো নিজেদের নম্বর ব্যবহার করে এ ধরনের কাজ করছে। এ বিষয়ে বিকাশ ওইসব নম্বর বা ফেসবুক অ্যাকাউন্টগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘বিকাশ নিয়মিতভাবে সন্দেহজনক লেনদেন মনিটর করে। কোন ধরনের সন্দেহজনক লেনদেনের প্রমাণ পেলে ওই নম্বরগুলো বিকাশ একাউন্ট হলে বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং বাংলাদশ ব্যাংকে সেন্ট্রাল ফিনান্সিয়াল ইনটিলেজেন্স ইউনিটকে অবহিত করা হয়।
এ ধরনের প্রতারণা বন্ধ করার প্রসঙ্গে বিকাশের জনসংযোগ বিভাগের এই কর্মকর্তা বলেন, মোবাইল ফিনান্সিয়াল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান মানুষকে সচেতন করার কাজ করে যাচ্ছে। গুটিকয়েক দুষ্টচক্র এই সেবার অপব্যবহার করছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়ত সফলও হচ্ছে। সেই বিষয়ে আমরা প্রতিনিয়ত সচেতনামূলক কার্জক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস রেগুলেটরি কমিশনও এ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে। তবে গ্রাহকদেরও সচেতন হতে হবে।
প্রিয় টেক/রিমন