
সিলেটের সাতকড়া ফল লিভার, কিডনি ও হার্টের রোগ প্রতিরোধক। ছবি: সংগৃহীত
হাজার গুণের ‘সাতকড়া’
আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৮, ১৪:০৩
(প্রিয়.কম) সিলেটের বাসিন্দাদের কাছে সাতকড়া ফলটি বেশ পরিচিত। তারা মাংস রান্নায় এই ফলের খোসা ব্যবহার করেন। এ অঞ্চলের প্রচলিত ধারণা সাতকড়ার খোসা মাংস রান্নায় ব্যবহার করলে মাংস তাড়াতাড়ি সিদ্ধ হয়। তবে গবেষণায় এই ফলটির কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঔষধিগুণও পাওয়া গেছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের, ল্যাবরেটরি অব ইনটেগ্রেটিভ অ্যান্ড অল্টারনেটিভ বায়োমেডিসিন ল্যাবের ৩৯ তম আবর্তনের এক তরুণ শিক্ষার্থী মো. আমিনুল ইসলাম (রানা) তার স্নাতকোত্তর থিসিস গবেষণা করেন সাতকড়ার ওপর। তিনি খুঁজে বের করেছেন এই ফলের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঔষধিগুণ যা বিশ্ববাসীর কাছে ছিল অজানা। তার এই গবেষণা কাজের জন্য তিনি জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ফেলোশিপ-২০১৫ পান।
এই গবেষণার বিষয়ে জানতে চাইলে মো. আমিনুল ইসলাম জানান, উক্ত বিভাগের শিক্ষার্থী সাকিব হোসেন এবং সাগরিকা দাস (মিতি) সাতকড়া ফলে প্রচুর পরিমাণ পলিফেনল, ফ্লেভোনয়েড, ট্যানিন ও ভিটামিন ‘সি’ খুঁজে পান। এসব উপাদান অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট নির্দেশক। এসব অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট জীবদেহে প্রতিনিয়ত ঘটে থাকা জারণ বিক্রিয়ার ফলে মৃত্যুর হাত থেকে আমাদের শরীরের লক্ষ লক্ষ কোষকে রক্ষা করে। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে ৪২টি ইঁদুরের উপর গবেষণা চালানো হয়।
গবেষণায় ইঁদুরগুলোকে সাতকড়া ফলের খোসা ডোজ হিসাবে খাওয়ানো হয়। এরপর ইঁদুরের লিভার ও কিডনি ড্যামেজ করার লক্ষ্যে প্যারাসিটামল ওভারডোজ দেওয়া হয়। গবেষণায় দেখা যায়, যে সকল ইঁদুরকে ফলের খোসা ডোজ হিসাবে খাওয়ানো হয়েছিল তাদের প্যারাসিটামল ওভারডোজ দেওয়ার পরেও লিভার, কিডনি ও হার্ট স্বাভাবিক ছিল।
তাছাড়া বিশ্বব্যাপী লিভার ডিজিজের জন্য ব্যবহার হওয়া ‘সিলাইমেরিন’ এর সমপরিমাণ গুণাগুণ পাওয়া গেছে সাতকড়া ফলে। মো. আমিনুল ইসলাম আরও জানিয়েছেন, এই ফল উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের উপকার করবে। রক্তে থাকা অতিমাত্রায় কোলেস্টেরল ধমনীর লুমেনে প্লাগ জমিয়ে স্ট্রোক এর মতো বিপদ ঘটানোর জন্য প্রধানত দায়ী লো-ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন যা এক ধরনের ক্ষতিকর কোলেস্টেরল। সাতকড়া রক্তের এই ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে দেয়। যারা নিয়মিত এই ফল খান তাদের লিভার, কিডনি এবং হার্ট রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে বলে আশা করা যায়।
প্যারাসিটেমল ওভারডোজ ইঁদুরের মতো মানুষের কী কী ক্ষতি করতে পারে এই বিষয়ে জানতে চাইলে এই তরুণ গবেষক জানান, অনেকেই হাল্কা জ্বর বা ব্যথা হলেই প্যারাসিটেমল খেয়ে ফেলেন যেহেতু এটা ওভার দ্যা কাউন্টার ড্রাগ মানে ডাক্তারের ব্যাবস্থাপত্র ছাড়াই ব্যবহার করা যায়। এই ব্যাপারে সবার সচেতন হওয়া উচিত, কারণ মাত্রাতিরিক্ত প্যারাসিটামল খেলে লিভার ও কিডনি একেবারে অকেজো হয়ে যেতে পারে।
এই ফল থেকে ঔষধ তৈরি হতে পারে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেহেতু আমরা এতে ক্ষতিকর কিছু পাইনি আর এটা ভেষজ এবং মানুষ খাচ্ছে। তাই এটা একটা ভালো ও সহজলভ্য ঔষধ হতে পারে যদি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো চায়।’
মাংস সিদ্ধ হওয়ার বিষয়ে সিলেটবাসীর ধারণা সে সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই বিষয়ে তারা গবেষণায় যাননি কিন্তু যেহেতু এই ফলে পলিফেনল আছে যা প্রোটিন ভাঙ্গতে পারে। যেহেতু মাংসে প্রোটিন থাকে তাই মাংস সিদ্ধ হওয়ার ধারণা হয়তো ঠিক।
প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সুদীপ পাল বলেন, ‘সাতকরা সিলেট অঞ্চলের একটি পরিচিত ফল যা মানুষ বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধের জন্য বহু বছর ধরে ব্যবহার করে আসছে। তবে এর মেডিসিনাল প্রোপার্টির কোন প্রমাণ ছিল না। তাই আমরা অ্যানিম্যাল মডেল এর উপর কাজ শুরু করলাম এবং দেখতে পেলাম এর মধ্য থাকা উপাদানগুলো মূলত এন্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে যা হার্ট, লিভার, কিডনি ও অন্যান্য অঙ্গপ্রতঙ্গেও রোগ প্রতিরোধ করে। এর সর্ম্পূণ ক্রিয়া কৌশল জানার জন্য আমাদের আরও পরীক্ষা-নীরিক্ষা করতে হবে। সাতকড়াকে রোগ প্রতিরোধক হিসেবে বাজারজাত করলে আমাদের দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী উপকৃত হবে বলে আমার বিশ্বাস।’
এ বিষয়ে প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ইব্রাহিম খলিল বলেন, ‘আমরা সাতকড়া ফলের তিনটি ইফেক্ট দেখেছি। প্রথমত এই ফলে কী কী উপাদান আছে, দ্বিতীয়ত ইঁদুরের লিভার ও কিডনির রোগ প্রতিরোধে সক্ষমতা এবং তৃতীয়ত ইদুরের মায়োকার্ডিয়াম ইনফ্রাকশন প্রতিরোধ। তিনটি ক্ষেত্রে আমরা ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি তাই মনে করি মানুষের ক্ষেত্রেও ফলাফল ভালো পাওয়া যাবে। এই ফলের গুণাগুণ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির বিবেচ্য বিষয় হতে পারে বলে আমি মনে করি।’
উল্লেখ্য, মো. আমিনুল ইসলামের এই গবেষণা কজে সার্বিক সহযোগিতা করেন এই বিভাগের অধ্যাপক ডঃ সিউ হুয়া গান (হিউম্যান জিনোম সেন্টার, ফ্যাকাল্টি অব মেডিক্যাল সাইন্স, ইউনিভার্সিটি সেইন্স মালেশিয়া)। এছাড়াও এতে জড়িত ছিলেন সাগরিকা দাস, সাকিব হোসেন, ই. এম. তানভীর, ইশতিয়াক আহমেদ সাকু, রোমানা আহমেদ, মারুফ বিল্লাহ প্রিন্স, নূর-ই-নওশীন রুম্পা, ফাহিমা জাহান আঁচল এবং উম্মে মাহফুজা শাপলা। এই গবেষণাপত্রটি যুক্তরাজ্যের প্রসিদ্ধ জার্নাল ‘Evidence-Based Complementary and Alternative Medicine’ এ প্রকাশিত হয়।
প্রিয় সংবাদ/গোরা