পদ্মা সেতু প্রকল্প নির্মাণ কাজের একটি অংশ। ছবি: সংগৃহীত

পদ্মা সেতু ও দক্ষিণাঞ্চলবাসীর স্বপ্ন

মোক্তাদির হোসেন প্রান্তিক
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১১ জুলাই ২০১৯, ১৭:১৬
আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৯, ১৭:১৬

(প্রিয়.কম) দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি পদ্মা সেতু। দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবে রূপ নেওয়ার পথে। এখন অধীরে আগ্রহে এক বিন্দুতে পদ্মার দুই তীরের মানুষেরা।

পদ্মা সেতু বাংলাদেশের পদ্মা নদীর ওপর নির্মাণাধীন একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু। এর মাধ্যমে লৌহজং, মুন্সিগঞ্জের সঙ্গে শরিয়তপুর ও মাদারীপুর যুক্ত হবে। যার মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব অংশের সংযোগ ঘটবে। দুই স্তর বিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ব্রিজটির ওপরের স্তরে থাকবে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরটিতে থাকবে একটি একক রেলপথ।

বর্তমান সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার প্রকল্প পদ্মা সেতু। সংশ্লিষ্ট তথ্য মতে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রায় ৬০ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। এতে খরচ হয়েছে ১৭ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা। কয়েক দফায় খরচ বাড়িয়ে প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।

বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্পটির যাত্রা শুরু হয় ২০০৭ সালে। সেনা-সমর্থিত সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ওই বছরের ২৮ আগস্ট ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করে। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপরিচলানার দায়িত্বে এসে রেলপথ সংযুক্ত করে ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি প্রথম দফায় সেতুর ব্যয় সংশোধন করেছে। মূল সেতু নির্মাণে কাজ করে যাচ্ছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। আর নদীশাসনের কাজ করছে চীনের আরেক প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশন। দুই প্রান্তে টোল প্লাজা, সংযোগ সড়ক, অবকাঠামো নির্মাণ করছে দেশীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সরে দাঁড়ায় বিশ্বব্যাংক

প্রকল্প প্রস্তুতির সঙ্গে যুক্ত কিছু লোকের দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় বিশ্বব্যাংক তার অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে নেয়। বিশ্বব্যাংকের পথ  অন্যান্য দাতারা অনুসরণ করে। 

দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ১২০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। তাদের অভিযোগ সেতুর কাজ পেতে বাংলাদেশি ও কানাডিয়ান কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ তুলে এবং বিশ্বব্যাংক দাবি করে, তাদের কাছে প্রমাণ রয়েছে।

দুর্নীতির এই অভিযোগ নিয়েই টানাপোড়েনের জের ধরে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায় বিশ্বব্যাংক। পরে নিজস্ব অর্থায়নেই বাংলাদেশ পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করে।

যদিও পরবর্তীতে দুর্নীতির অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। বাংলাদেশ বরাবরই দাবি করছিল, উন্নয়নের পথে বাধা তৈরি করতে পদ্মা সেতু প্রকল্পে মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়। এটা ষড়যন্ত্রের একটি অংশ।

পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধে হাত ছিল ইউনূসের: প্রধানমন্ত্রী

গত বছরের ১৪ অক্টোবর মুন্সীগঞ্জের মাওয়া টোলপ্লাজা সংলগ্ন গোলচত্বরে পদ্মা সেতু প্রকল্পের অগ্রগতি এবং এর রেল সংযোগের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এ সময় তিনি বলেন, পদ্মা সেতু তৈরিতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. ইউনূসের হাত ছিল। ইউনূসের প্ররোচণায় বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়।

এগিয়ে চলছে পদ্মাসেতুর কাজ। ফাইল ছবি

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণ করা ছিল আমাদের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। সাহসের সাথে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে কোটি মানুষের প্রাণের দাবি পূরণ করতে চলেছি। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। সকল চক্রান্ত রুখে দিয়ে বিশ্বের কাছে আমরা প্রমাণ করেছি, আমরা পারি। কারণ বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি, পারবে না।’

এক নজরে পদ্মা সেতু

পদ্মা সেতু প্রকল্পের নাম হচ্ছে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার, প্রস্থ ৭২ ফুটের চার লেনের সড়ক। পদ্মা সেতুতে রেললাইন স্থাপন থাকবে নিচ তলায়। দ্বিতল বিশিষ্ট এই সেতু কংক্রিট আর স্টিল দিয়ে নির্মিত হবে। সেতুটির পিলার সংখ্যা ৪২টি। সেতুটির ভায়াডাক্ট ৩.১৮ কিলোমিটার। ভায়াডাক্ট পিলার ৮১টি। সেতুর সংযোগ সড়ক দুই প্রান্তে ১৪ কিলোমিটার। প্রকল্পে নদীশাসন হয়েছে দুই পান্তে ১২ কিলোমিটার। প্রকল্পে কর্মরত জনবল প্রায় ৪ হাজার। পানির স্তর থেকে পদ্মা সেতুর উচ্চতা ৬০ ফুট। পদ্মা সেতুর পাইলিং গভীরতা ৩৮৩ ফুট, প্রতি পিলারের জন্য পাইলিং ৬টি, মোট পাইলিং সংখ্যা ২৬৪টি। এ ছাড়াও পদ্মা সেতুতে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অপটিক্যাল ফাইবার লাইন পরিবহন সুবিধা থাকবে। আর পদ্মা সেতু প্রকল্পে চুক্তিবদ্ধ কোম্পানির হচ্ছে চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড।

পদ্মা সেতুর জন্য ৫ হাজার ৩৭০ কোটি

২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাজেটে পদ্মা সেতু প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫ হাজার ৩৭০ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। গত অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। সে তুলনায় চলতি অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ বাড়ছে ২ হাজার ৭১৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।

পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যান চলাচল ২০২০ সালে

পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেছেন, মূল বা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল সেতুর পাইল ডাইভিং। এটি সম্পন্ন হয়েছে। এখন তো প্রকল্পের কাজ দ্রুত চলছে। জাজিরায় অনেক স্প্যান বসে গেছে। মাওয়ার কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড থেকে দূরত্ব কমে এসেছে। তাই কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড থেকে দু–এক দিনের মধ্যেই একটি করে স্প্যান পিয়ারের ওপর বসানো সম্ভব। ১৩টি পিয়ার নির্মাণকাজ শেষ হলে আশা করা যায় ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন করতে পারবে।

গুজবে কান দেবেন না: সেতু কর্তৃপক্ষ

সম্প্রতি পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে বলে একটি গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এতে বিভ্রান্ত না হতে দেশবাসীর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।

মঙ্গলবার এক বিজ্ঞপ্তিতে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প পরিচালক মো.শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ পরিচালনায় মানুষের মাথা লাগবে বলে একটি কুচক্রী মহল বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে অপপ্রচার চালাচ্ছে তা প্রকল্প কর্তৃপক্ষের নজরে এসেছে। আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, এটি একটি গুজব। এর কোনো সত্যতা নেই। এমন অপপ্রচার আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ধরনের গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য দেশবাসীকে অনুরোধ করা যাচ্ছে।’

বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। মূল সেতুর ২৯৪টি পাইলের মধ্যে ২৯২টি বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। ৪২টি পিয়ারের মধ্যে ইতিমধ্যে ৩০টি পিয়ারের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এ পর্যন্ত ১৪টি স্প্যান স্থাপন করা হয়েছে, যা এখন দৃশ্যমান। ৩০ জুন পর্যন্ত মূল সেতুর বাস্তব কাজের অগ্রগতি ৮১ শতাংশ, নদীশাসন কাজের অগ্রগতি ৫৯ শতাংশ এবং প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৭১ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে।

আবহাওয়া ঠিক থাকলে ১৪ জুলাইয়ের মধ্যে বসে যেতে পারে সেতুর সর্বশেষ ২৯৪ নম্বর পাইল। এর মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হবে পদ্মা সেতুর পাইল বসানোর কাজ। সেতু কর্তৃপক্ষের আশা, এ বছর পদ্মা সেতুর ২৯৪টি পাইলের ওপর ৪২টি পিয়ারের সব কটিই তৈরি হয়ে যাবে।

২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর মাওয়া থেকে শুরু হয় পদ্মার সেতুর নির্মাণকাজ। কাজের শুরুতেই নদীর তলদেশের গভীরে পাওয়া যায় নরম মাটির স্তর। তাই হ্যামার দিয়ে পাইল বসাতে গিয়ে ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১, ১২, ২৬, ২৭, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২ ও ৩৫ নম্বর পিয়ারের কাজে সমস্যা দেখা যায়। এ কারণে ১৪টি পিয়ারের নকশা চূড়ান্ত করা যাচ্ছিল না। সমস্যা সমাধানে কাজ শুরু করে ব্রিটিশ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কাউই (সিওডব্লিউআই) ইউকে লিমিটেড। কাউই ইউকের বিশেষজ্ঞরা মাটি পরীক্ষার প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন তথ্য যাচাই করেন। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় আরও কয়েকটি বিদেশি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ দলের কয়েক দফা বৈঠক হয়। কাদামাটির পরই শক্ত মাটি না পাওয়ায় পদ্মা সেতুর ২২টি পিয়ারে একটি করে পাইলের সংখ্যা বাড়ানো হয়। এসব খুঁটিতে ছয়টি পাইল অন্যান্য পিয়ারের মতোই রেকিং বা কিছুটা বাঁকা করে বসানো হবে। এই ছয়টি পাইলের মধ্যে ৭ নম্বর পাইল ভার্টিক্যাল বা সরাসরি সোজাভাবে বসানো হয়।

 প্রিয় সংবাদ/রিমন