
মোস্তাফা জব্বার। ফাইল ছবি
‘বিজয়’ বাংলা সফটওয়্যারের তিন দশক ও তার কারিগর
আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৪:৩০
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, বিজয়ের ৪৮ বছর পার হতে যাচ্ছে। ভাষার সৌন্দর্যটা কি আমরা আজও উপলদ্ধি করতে পেরেছি? আমরা কি ধারণ করতে পেরেছি আমাদের বর্ণমালাকে? না, পারিনি। কিন্তু যে মানুষটি আজও বিজয়কে আগলে রেখে কোটি মানুষের মাঝে বিজয়ের বাণী পৌঁছে দিয়েছেন,পরিবর্তনের নতুন ধারা উম্মোচন করেছেন, তিনি মোস্তাফা জব্বার। বলছিলাম প্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বারের কথা। বয়স ৭০-এর কাছাকাছি। একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন সফল মানুষ।
১৯৪৯ সালের ১২ আগস্ট আশুগঞ্জের চারতলা গ্রামে নানার বাড়িতে জন্ম। নানা আবু বকর সিদ্দিক নাম রাখলেও সার্টিফিকেটে স্থান পায় নানির দেওয়া নাম গোলাম মোস্তাফা। কিন্তু নামটিও স্থায়ী হলো না। ৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে শেষ পর্যন্ত নিজের দেওয়া নাম মোস্তাফা জব্বারেই স্থায়ী হয়ে যান। যে নামটি হয়ে ওঠে একটি ইতিহাস। নানার বাড়ি আশুগঞ্জ হলেও দাদার বাড়ি নেত্রকোণার কৃষ্ণপুর গ্রামে। যেখানে অনেক বাউল সাধক শিল্পীর জন্ম। বাবা আব্দুল জব্বার তালুকদার ব্যবসায়ী ছিলেন, ছিলেন আধ্যাত্মিক ভাবনার। চারতলা প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি, গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর বাড়ি থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জের হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন। ১৯৬৬ সালে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। সেই থেকে জড়িয়ে যান জীবনের নতুন মোড়ে। শুরু করেন রাজনীতির সঙ্গে সাংবাদিকতা। করেছেন মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলা, ভূখণ্ড পতাকা ছিনিয়ে আনা বীরদের একজন। সময়ের পরিক্রমায় হয়ে উঠেন প্রযুক্তিবিদ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য থেকে পাশ করা একটা মানুষ প্রযুক্তিবিদ হয়ে যাওয়ার গল্পটা চারটেখানি কথা নয়, আজ সে অসাধারণ অভিজ্ঞতার কথা লিখতে চাই। লিখতে চাই কারিগরের মুখ থেকে শোনা সে তীব্র অনুভূতির কথা।
আগে মোস্তাফা জব্বারের মুখেই অভিজ্ঞতা শোনা যাক—
আমার কর্মজীবন শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। ১৯৬৭ সালে প্রথম গল্প লিখি। সেটি “জনতা” নামে একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। গল্পের নাম ছিল “শান্তির সন্ধানে”। ওটাই আমার প্রকাশিত প্রথম লেখা। মুক্তিযুদ্ধের পর “দৈনিক গণকণ্ঠ” প্রকাশিত হয়। ১০ জানুয়ারি ওটার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। আমি ১৬ জানুয়ারি যোগ দিই। আল মাহমুদ ছিলেন ওটার এডিটর। এর এক্সিকিউটিভ এডিটর ছিলেন আফতাব আহমেদ। তিনি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। “গণকণ্ঠ” ছিল মূলত জাসদের মুখপত্র। জাসদের কর্মকাণ্ড স্তিমিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গণকণ্ঠও বন্ধ হয়ে যায়। চাকরিটা হারানোর পর একটা ব্যবস্থা তো করা দরকার। এরপর “এয়ার ফ্রেন্ডস” বলে একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি নিই। অফিসটা ছিল দিলকুশায়। চাকরিটা ছিল প্রায় পিয়নের। পিয়নের মানে হলো, তখনকার দিনে বাংলাদেশ থেকে টিকেট করতে হতো বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে। কারণ তার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার সম্পর্ক ছিল। এক ভদ্রলোক ব্যাংকে যেতেন এইসব কাজ করার জন্য। আমি ওনার ব্যাগ ক্যারি করতাম। এইটা আমার জীবনের প্রথম চাকরি।
কিছুদিন পর আমি অনুভব করলাম ট্রাভেল এজেন্সিতে যদি ক্যারিয়ার তৈরি করতে হয় তাহলে এই বিষয়ে আমার জ্ঞান অর্জন করতে হবে। ট্রাভেল এজেন্সি পরিচালনা করার জন্য প্রধানতম হাতিয়ার টিকেটিং। টিকেটিং হলো টিকেটের ট্যারিফ এবং অন্যান্য বিষয়। একটি ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে আমি এগুলো আয়ত্ব করে ফেলি। এই দক্ষতার জন্য আমার পদোন্নতি হয়। কিছুদিন পর এক ভদ্রলোক বললেন, “আপনি তো টিকেটিং বিষয়ে ভালো জানেন, আমরা একটি ট্রাভেলিং এজেন্সি করব, আপনি আমাদের সাথে যোগ দিন।” ৮০০ টাকা মাসিক বেতন এবং ২৪ ভাগ শেয়ারের শর্তে আমি ওখানে কাজ শুরু করলাম। এরপর কিছুদিন পরে আমি নিজেই একটি ট্রাভেল এজেন্সি দিয়ে ফেললাম। কারণ ভেবে দেখলাম, ট্রাভেল এজেন্সির জন্য কোনো টাকার দরকার নেই। আমার দক্ষতা আর পরিচিতিই যথেষ্ট, যা আমার ছিল। এখন যেখানে আমার অফিস—আরামবাগ, ওখানেই দুইটি রুম ভাড়া নিয়ে শুরু হয় আমার অফিস। আমার ট্রাভেল এজেন্সির সাথে আমার পরিবারই যুক্ত থাকত। আমি লিমিটেড কোম্পানি করলাম। আমি, আমার ছোট ভাই, আমার স্ত্রী এবং আমার শ্যালক এই চার জন মিলে কোম্পানি যাত্রা শুরু করি। এটিই আমার প্রথম নিজের ব্যবসা। এটি ৭৬ সালের কথা।
প্রথম জীবনে সাংবাদিকতা করেছি। ফলে মন থেকে তার রেশ কাটেনি। ’৮১ সালের দিকে ফাতেমিয়া প্রেস নামের একটি প্রেস ভাড়া করি। সিসার হরফের সেই প্রেসে ভালো কাজ করতে পারছিলাম না। কোনোভাবে চালিয়ে নিয়েছিলাম। ’৮৩-এর দিকে আমি আরামবাগেই নিজস্ব একটি প্রিন্টিং মেশিন স্থাপন করলাম। যেটিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি যুক্ত হয়েছিল। আমাদের ট্রাভেল এজেন্সির নাম ছিল “আনন্দ ভ্রমণ” আর প্রিন্টিং প্রেসের নামকরণ করা হলো “আনন্দ মুদ্রায়ণ”। ’৮৩ সালের মার্চে আমি “নিপুণ” পত্রিকা প্রকাশ করলাম। এটি ছিল বিনোদন কাগজ। শাহজাহান চৌধুরী ছিলেন এর সম্পাদক। নিপুণ একটি মাইল ফলক সফলতা আনল। মনে আছে পত্রিকার প্রথম সেই সংখ্যাটি আমি সারা মাস ধরে ছেপেছিলাম। হকারদের লাইন লেগে থাকত সেটি কেনার জন্য। এই ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তার কারণ হতে পারে যে, সেই সংখ্যাটি করা হয়েছিল বেগম জিয়াকে নিয়ে। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী বেগম জিয়ার বর্তমান অবস্থান নিয়ে অন্য কোনো পত্রিকা কোনো স্টোরি করেনি বলেই হয়তো এটির এই জনপ্রিয়তা। আর একটি কারণ ছিল, আমরাই প্রথম বেগম জিয়ার দুই সন্তানসহ কাভারে রঙিন ছবি ছেপেছিলাম। যেটিও একটি অন্যতম আকর্ষণের কারণ। এটি পলিটিক্যাল কোনো স্টোরি ছিল না। লেখাটির শিরোনাম ছিল “খালেদা জিয়ার দিনকাল”। অর্থাৎ বেগম জিয়ার দৈনন্দিন জীবনযাপনই ছিল এর প্রধান বিষয়। এরপর ধারাবাহিকভাবে শেখ হাসিনা, রওশন এরশাদকে নিয়ে কাভার স্টোরি করলাম। এই তিনটি সংখ্যাতেই পত্রিকাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়।
আমরা আর একটা কাজ করলাম। রঙিন ছবি ছাপতে শুরু করলাম। যেটি সবে দু-চারটি পত্রিকা শুরু করেছে। “তারকালোক”, “চিত্রালী”, “পূর্বাণী” ইত্যাদি পত্রিকাগুলো তখন রঙিন হয়ে উঠছে। নিপুণ নিয়ে আমার একটি অতৃপ্তি তৈরি হলো। সেটি হলো লেখার ফন্ট সুন্দর নয়। এত খাটাখাটনি করতাম, এত সুন্দর রং ব্যবহার করছি, ফটোগ্রাফি করছি, তখন আমার পত্রিকার ফটোগ্রাফার ছিলেন নাসির আলী মামুন; কিন্তু ফন্টের জন্য পত্রিকা ভালো লাগছিল না। আমার পত্রিকায় তখন কবি অসীম সাহাও কাজ করেন। আমার অসন্তোষ দেখা দিলো অক্ষর নিয়ে। সিসার হরফ পছন্দ হয় না। তখন ফটোটাইপ সেটার চলে এসেছে। কিন্তু সেটি খুবই ব্যয়বহুল, প্রায় কোটি টাকা। তখনকার দিনে এক ফর্মা কম্পোজ করতে তিন হাজার টাকা লাগত। আমি শেষপর্যন্ত ফটোটাইপ সেটাপ কেনার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু সমস্যা হলো, আমার যে ফন্ট পছন্দ সেটা তারা দিতে পারবে না। নতুন ফন্ট দিলেও তারা সময় নেবে ৬ মাস, সেইসঙ্গে তাদের দিতে হবে ৭শ পাউন্ড। লন্ডনে বসে তাদের সবকিছু দেখে অপছন্দ হলো, আমি ফিরে এলাম। ফিরে এসে দেখলাম “ঢাকা কুরিয়ার” নামে একটি ইংরেজি পত্রিকা বেরিয়েছে কম্পিউটার কম্পোজে। যে প্রেস থেকে এটা ছাপা হতো আমি সেখানে গেলাম। তারা বলল, ইংরেজি ফন্ট ছাড়া তো এটা সম্ভব নয়। মাহমুদুল হাসান তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তাকে ধরে আমি “সাপ্তাহিক আনন্দপত্র” নামে একটি পত্রিকার ডিক্লারেশন বের করলাম। আমি আবার “সাপ্তাহিক আনন্দপত্র” বিষয়ে ওই প্রতিষ্ঠানে গেলাম। ওনারা একই রকম সমস্যার কথা বললেন। মূল সমস্যা হলো, বাংলা ফন্ট যেটা আছে সেটা সুন্দর না। পরে আমার পরামর্শে কি-বোর্ড চেঞ্জ করে একটি সমাধানে পৌঁছানো হলো। এভাবে ১৬ মে ১৯৮৭ সালে কম্পিউটার টাইপে আনন্দপত্র বের হলো। বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটার টাইপ পত্রিকা।
এর কিছুদিন পর আমার মনে হলো কম্পিউটার টাইপ পত্রিকার একটি বাণিজ্যিক সম্ভাবনা আছে। যেটা করতে হলে সিসার হরফ সরিয়ে কম্পিউটারের ব্যবহার শুরু করতে হবে। যেহেতু মূল সমস্যা অক্ষর, আমি সিদ্ধান্ত নিলাম নতুন অক্ষর ডিজাইন করাব। হামিদুল ইসলাম নামের এক ছোট ভাইকে দিয়ে আমি অক্ষরের ডিজাইন করালাম। একটি সফটওয়্যার পাওয়া গেল যেটা দিয়ে ফন্ট বানানো যায়। আমি নিজেই ডেভেলপ করতে শুরু করলাম। আমি তখন কম্পিউটারে টাইপ করতে পারি, ছবি নিয়ে কাজ করতে পারি আর ফন্ট বানাতে পারি। হামিদুলের ডিজাইন আর আমার কম্পিউটারের কাজ মিলিয়ে তৈরি হলো নতুন একটি ফন্ট—আনন্দ। আমার আনন্দপত্রে এই ফন্ট প্রথম ব্যবহার করলাম এবং ’৮৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথমবারের মতো “দৈনিক আজাদ” পত্রিকা এই ফন্ট ব্যবহার শুরু করল। এটি দেখে অন্যান্য পত্রিকাও এটির ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠল। এর সুবিধাও ছিল অনেক। আগে কম্পোজ করতে যেখানে একশজন লোক লাগত, সেখানে এটাতে লাগত মাত্র ১০ জন। দেখতে সুন্দর। কিন্তু এটাতেও একটা সমস্যা দেখা দিলো। বাংলা টাইপ দ্রুত হয় না। আমার পত্রিকাসহ সব পত্রিকা থেকেই দাবি উঠল, বাংলা টাইপ দ্রুত করার ব্যবস্থা করুন। আমি নতুন করে চিন্তা করতে শুরু করলাম, কী করা যায়। এমন কিছু একটা করতে হবে যেন বাংলা সব অক্ষরই টাইপ করা যায় আবার কি-বোর্ডের ৪ স্তর না লাগে।। কি-বোর্ডের বোতামের সংখ্যা না বাড়িয়ে অর্থাৎ সবমিলিয়ে ৪৫৪টা বর্ণ ২৬টা বোতামের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। আমি অনেকের কাছে গেলাম, সবাই বিস্ময়ের সঙ্গে অপারগতা স্বীকার করলেন। তারপর ’৮৮ সালের শেষের দিকে আমি একটি কি-বোর্ডের লে-আউট চূড়ান্ত করতে সক্ষম হলাম। কিন্তু এটাকে তো ডেভেলপ করতে হবে। সারা দেশে কাউকেই খুঁজে পেলাম না, যে এটা করতে পারে। শেষে গেলাম ভারতে। দিল্লিতে দেবেন্দ্র যোশী নামের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি সব শুনে বললেন, ‘করা যাবে’। আমার দাবি ছিল কম্পিউটারের কি-বোর্ডের ৫৫টি বোতামের মধ্যে বাংলা সবগুলো অক্ষর থাকতে হবে। তিনি রাজি হলেন। এরপর দিল্লির কুতুব হোটেলের ডি২ ফ্লাটে তিন দিন তিন রাত বসে আমরা দুজন এই কাজটি করতে সক্ষম হই। প্রথম আমি ক হসন্ত ত টাইপ করার পর যখন ‘ক্ত’ দেখিয়েছে তখন আমার আনন্দ দেখে কে। সেটি ৮৮ সালের ডিসেম্বরের দুই-তিন তারিখের দিকে হবে। ছোট্ট একটি প্রোগ্রাম, মাত্র তিন কিলোবাইট হবে। ওইটা ফ্লপি ডিস্কে নিয়ে আমি দেশে ফিরে এলাম। দেশে ফিরে আসার পর মনে হলো এটাকে একটু স্মরণীয় করে রাখা দরকার। এটি প্রকাশ করলাম ১৬ ডিসেম্বর। নামও ঠিক করলাম ‘বিজয়’। এটা ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসের মধ্যে কম্পিউটার টাইপ প্রচলিত সব পত্রিকা গ্রহণ করল। তারা যখন এটা পেল তখন চার স্তরে আর টাইপের ঝামেলা থাকল না। টাইপ বিস্ময়কর রকমের দ্রুততর হলো। কম্পিউটার মোবাইলসহ সব কিছুতে বাংলা ভাষাকে প্রযুক্তিগতভাবে ডিজিটাল যুগের জন্য উপযোগী করার প্রথম পদক্ষেপ ছিল এই উদ্ভাবন। এর সুফল হলো ’৯৩ সালের পর বাংলাদেশের সকল বই, পত্র-পত্রিকাসহ প্রকাশনার সব ক্ষেত্রে কম্পিউটার ব্যবহার শুরু হয়।
এভাবে মেধা আর প্রতিভার বিস্ময়কর সমন্বয়ে মোস্তাফা জব্বার তৈরি করেন এক নতুন গল্প, বিজয়ের গল্প। এ গল্প সমগ্র বাঙালির, সমগ্র বাংলা ভাষাভাষীর। এ মানুষটি না থাকলে হয়তো অন্যান্য ভাষার মতো বাংলা ভাষাও হারিয়ে যেত এক সময়। তিনিই আমাদের রক্তাক্ত বর্ণমালাকে তুলে এনে সাজিয়েছেন বর্ণিল রঙে। সে বর্ণমালা আজ নতুন প্রাণে বিজয়ের বেশে ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র বাঙালির মাঝে। হয়তো এ মানুষটি না থাকলে এমনটা হতো না।
বর্তমানে একটা শোচনীয় ব্যপার হচ্ছে আমরা যুক্তিহীনতায় ভুগি, প্রশংসিত করে ফেলি ভ্রান্ত চিন্তা, ভ্রান্ত মগজকে। যে চিন্তা ভুল, বর্জনীয়, সে চিন্তাকে আঁকড়ে ধরি, দিকে দিকে ছড়িয়ে দেই—এটি সম্পূর্ণ অন্যায়। আমরা রোমান হরফে বাংলা লেখার অপকৌশলটা ছড়িয়ে দিয়েছি, আর এর সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে আমাদের তরুণ প্রজন্ম। প্রতিনিয়ত তাদের মগজকে আমরা অসুস্থ করে দিচ্ছি, এর থেকে শোচনীয় আমাদের জন্য আর কি হতে পারে। আমাদের ভাষা কতটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে তরুণদের রোমান হরফে বাংলা লেখাগুলো পড়লে বোঝা যায়। আসলে আমরা বুঝতে পারি না কোনটা আমাদের সফলতা, কোনটা আমাদের ব্যর্থতা। কেবল ডিজিটাল যন্ত্রে বাংলা লেখার উপায় উদ্ভাবন করলে হয় না, সেটি কতটা শুদ্ধতার পরিচয় বহন করে সেটিই দেখার বিষয়। বিজয় ছাড়া অন্য কোনো লে-আউট সে সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। বিজয় কি-বোর্ডকে এড়িয়ে যাবার জন্য বিভিন্ন পক্ষ বছরের পর বছর প্রচণ্ড চেষ্টা চালিয়েছিল। ২০০৩ সালে বেগম খালেদা জিয়ার সরকার এই কি-বোর্ড ও সফটওয়্যারকে প্রমিত না করার জন্য স্বৈরতান্ত্রিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। অন্যদিকে এই কি-বোর্ডের বদলে রোমান হরফ দিয়ে বাংলা লেখার জঘন্য প্রচেষ্টাও গ্রহণ করা হয়েছিল। অথচ এত কিছুর পরও বিজয়কে বর্জন করা সম্ভব হয়নি। বিজয়-এর যাত্রা অব্যাহত আছে। বিজয় এখন বাংলাদেশে কম্পিউটারে বাংলা লেখার জাতীয় মান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কম্পিউটারের আনুসঙ্গিক যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক সুইজ কোম্পানি লজিটেক তাদের কি-বোর্ডে বিজয় বাংলা লেআউট যুক্ত করেছে, ভারতীয় উপমহাদেশের আর কোনো ভাষায় তারা লজিটেক কীবোর্ড প্রস্তুত করে না। এটি আমাদের জন্য একটি বড় অর্জন।
বাংলাদেশের প্রতিটি পত্রিকা থেকে শুরু করে প্রকাশনা শিল্প-অফিস-আদালত সর্বক্ষেত্রে বিজয় ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বাংলা ব্যবহারকারীদের নিকট বিজয় এখন প্রমিত বাংলা কি-বোর্ডে পরিণত। কম্পিউটারে বাংলা ভাষার প্রয়োগ, সাধারণ মানুষের হাতে কম্পিউটার পৌঁছানো, স্কুল-কলেজে কম্পিউটার পৌঁছানো, কম্পিউটারভিত্তিক স্কুল চালু, বই লেখা, গ্রাফিক্স মাল্টিমিডিয়া প্রশিক্ষণ চালু, মেধাসত্ত্ব সংরক্ষণ, সফটওয়্যার শিল্পের বিকাশসহ সর্বক্ষেত্রে একক ও অনন্য ভূমিকার এক ব্যক্তিত্ব তিনি। কম্পিউটারে বাংলা লিখার জন্য মোস্তাফা জব্বার একজন অগ্রপথিক এবং স্মরণীয়।
গত ৩০ বছরে “বিজয়” দেশ-বিদেশে অর্জন করেছে অসাধারণ সফলতা। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সেরা সফটওয়্যারের পুরস্কার থেকে শুরু করে এসোসিও’র সম্মাননা বেস্টওয়ে পুরস্কার বা পিআইবি সোহেল সামাদ পুরস্কার কিংবা নেত্রকোণার গুণীজন সম্মাননা সবকিছুর পেছনেই রয়েছে “বিজয়”। মোস্তাফা জব্বারকে একদম সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে “বিজয়”।
আজ চারপাশে তার খ্যাতি। এই দেশে তিনিই স্বপ্ন দেখিয়ে চলেছেন ডিজিটাল বাংলাদেশের। শিশুদের দিয়েই শুরু করেছেন এ প্রাণবন্ত এবং বৈচিত্র্যময়। তার একটি অন্যতম কৃতিত্ব হচ্ছে প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থার বদলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন রুচিবোধ এনছেন। ধরে রেখেছেন প্রজন্মের চাহিদা, শিক্ষার নতুন রূপ। সাধারণ মানুষকে এমন শিক্ষার সাথে পরিচিত করতে শিক্ষার নতুন রূপ তৈরি করতে উপেক্ষা করতে হয়েছে অনেক কিছু। যার সবটুকু হয়তো উদ্ধৃত করা সম্ভব নয়। এমন অনেক বিতর্কের মাঝেও তিনি ভয়াবহ সত্যোচ্চারণ করেছিলেন বলে অনেকের কাছে তিনি অপ্রিয়। তাই তিনি শিকার হয়েছেন অনেক সমালোচনার। প্রায় ৪ যুগ ধরে যারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছিলেন, বিজয়ের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন সেই চক্রান্ত ব্যর্থ হয়ে আজ সোনালি ফসল ফলতে শুরু করেছে। যেসব চক্রান্তকারীরা এত দিন বাইরে থেকে কাজ করেছে শিক্ষার নতুন রূপে ঘরের ভিতরে আজ বিকশিত হচ্ছে তাদের শিশু। এই মানুষটি প্রথম ভেবেছিল বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে ডিজিটাল শিক্ষার বিকল্প নেই। যারা ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে হাসি তামাশা করেছিল তাদের হতাশ হতে সময় লাগেনি।
বর্তমানে শিক্ষাখাতে কতটা উন্নত হয়েছে জানি না। শুধু জানি, এ মানুষটি ডিজিটাল শিক্ষার জন্য করেছেন অনেক কিছু। বর্তমানে একটি সংকট হচ্ছে, কোনো আদর্শ দিয়ে নিজেদের সফল প্রমাণ করতে হয় না। কিন্তু এ মানুষটিকে সবসময় আদর্শ দিয়ে প্রমাণ করতে হয়েছে নিজের সাফল্য। বিজয়ের চিরস্থায়ী রূপ বিধিবদ্ধ হয়ে গেছে। এ রূপ নিয়ে হাজার হাজার ভবিষ্যৎ শতাব্দী বাস করবে, গড়ে তুলবে ডিজিটাল বাংলাদেশ। কারিগর থাকবে এ মানুষটি। ২০১৮ সালে তিনি এগারো মাস ছয় দিন ডাক টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।
[প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রিয়.কম লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত মতামতের সঙ্গে প্রিয়.কম-এর সম্পাদকীয় নীতির মিল না-ও থাকতে পারে।]