
গণিত মানেই ভয় নয়: শিক্ষার দুর্বল সূত্রে ধরা পড়ে ভবিষ্যৎ
আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় গণিত বরাবরই একটি দুর্বোধ্য বিষয় হিসেবে পরিচিত। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কাছেই এটি কঠিন ও জটিল বলে মনে হয়। অবশ্য এই জটিল মনে হওয়ার দায় আমাদের বড়দের।
শুধু শিক্ষার্থীরা নয়, অনেক শিক্ষকও গণিতকে দুর্বোধ্য মনে করেন। শৈশব থেকেই শিক্ষার্থীদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যে, গণিত একটি কঠিন বিষয় এবং এতে কোনো আনন্দ নেই। প্রথমে এই ধারণা জন্ম দেন মা-বাবা এবং অন্যান্য অভিভাবক, এরপর সেটি আরও গভীরভাবে প্রোথিত করেন শিক্ষক।
অভিভাবকের ভূমিকা একপাশে রাখলেও যখন স্কুলের শিক্ষক নিজেই বলেন—‘গণিত জটিল’, তখন সেটি শিক্ষার্থীর মনে স্থায়ীভাবে বসে যায় এবং এক ধরনের ভয় বা মানসিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। পরে সেই শিক্ষার্থী গণিতে যতটুকু গুরুত্বই দিক না কেন, প্রকৃত অর্থে লাভ হয় না। কারণ শুরুতেই তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, বিষয়টি তার বোধের বাইরে।
স্কুল পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় গণিতে। এ রপরেই গুরুত্ব পায় ইংরেজি। কিন্তু বছরের পর বছর কেটে গেলেও এই দুই বিষয়ে শিক্ষার্থীদের অবস্থার তেমন উন্নতি হয় না। বরং পরিস্থিতি আগের মতোই রয়ে গেছে, এমনকি আরও জটিল আকার ধারণ করেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে—গণিতে এই দুর্দশার কারণ কী?
অভিভাবকরা সন্তানকে গণিতে পাস করাতে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করছেন। এখানেই রয়েছে একটি বড় দুর্বলতা। কেবল পাস করানোর মানসিকতা থেকেই গণিত পড়তে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। শিক্ষকরা এখনও সেই পুরোনো, পরীক্ষামুখী পদ্ধতিতে ক্লাস করিয়েই দায় সেরে ফেলছেন। ফলে শিক্ষার্থীরা মুখস্থ বিদ্যার ওপর নির্ভর করেই পরীক্ষার ‘সেতু’ পার হচ্ছে।
এই প্রবণতা গণিতের শেখায় এক জটিল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকের চোখে এখন গণিত মানে শুধু ‘যেভাবে হোক ভালো নম্বর পাওয়া। নিদেনপক্ষে পাস করতে পারা।’ এমনকি যারা ভালো ফল করছেন, তাদেরও একটি বড় অংশ কেবল নম্বর তোলার জন্যই বিষয়টি পড়ছে—আসল আগ্রহ কিংবা আনন্দের জায়গাটা সেখানে নেই।
যুগের পর যুগ একই মানসিকতা, একই পদ্ধতি আর শিক্ষকদের একই ঘরানার কৌশল—এসব মিলে গণিত শিক্ষায় এক স্থবিরতা ও বিমুখতা তৈরি হয়েছে। ফলাফল রীতিমতন ধ্বংসযজ্ঞ।
এ বছর যখন উত্তরপত্র মূল্যায়নে কিছুটা গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, তখনই তা পাসের হারে সরাসরি প্রভাব ফেলেছে এবং এর মূল কারণ হিসেবে উঠে এসেছে—গণিতে শিক্ষার্থীদের খারাপ ফলাফল।
গণিত শিক্ষাকে সহজতর করতে শিক্ষক প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও, বাস্তবে সেই প্রশিক্ষণের প্রয়োগ খুব কমই চোখে পড়ে। পাঠদানে নানা উপকরণ ব্যবহারের সুযোগ থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা ব্যবহার হয় না। এখনও অনেক শিক্ষক চক আর ডাস্টারের মধ্যেই আটকে আছেন। অন্যদিকে, বিশ্বে মানুষ গণিত ব্যবহার করে মহাকাশে পাড়ি দিচ্ছে, একের পর এক নতুন আবিষ্কার করছে। কারণ, গণিত ছাড়া বিজ্ঞান কল্পনাও করা যায় না।
এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠতেই পারে—যখন গণিত শিক্ষার এই দুর্বল অবস্থা, তখন আমরা দেশে ভালো কোনো গণিতবিদ বা বিজ্ঞানী তৈরির আশা কীভাবে করতে পারি?
সদ্য প্রকাশিত এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, ৬ লাখ ৬৬০ জন শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। এত বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী পাস না করায় স্বাভাবিকভাবেই কারণ অনুসন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সবাই। এই বিশ্লেষণেই উঠে এসেছে গণিত বিষয়ে শিক্ষার্থীদের ভরাডুবির চিত্র। পরীক্ষার্থীদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ গণিতে পাস করতে পারেনি।
পরিসংখ্যানের দিক থেকেও গণিতের অবস্থান উদ্বেগজনক। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলগুলোতে বর্তমানে গণিত শিক্ষকের সংখ্যা ৬৪ হাজার ১৪৭ জন। কিন্তু এর মধ্যে ৮৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ শিক্ষকের গণিতে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেই!
পরিসংখ্যানে আরও দেখা যায়, মাধ্যমিকে গণিতে স্নাতক (অনার্স) ডিগ্রিধারী শিক্ষক আছেন মাত্র ৩ হাজার ৮৩৬ জন, যা মোট শিক্ষকের মাত্র ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ। অন্যদিকে, স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী শিক্ষকের সংখ্যা ৪ হাজার ৬৪৩ জন, যা মোটের মাত্র ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ।
অর্থাৎ, গণিত বিষয়ে প্রয়োজনীয় একাডেমিক যোগ্যতা ছাড়াই মাধ্যমিকে এই বিষয় পড়াচ্ছেন ৮৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ শিক্ষক।
- ট্যাগ:
- মতামত
- গণিত
- শিক্ষা ব্যবস্থা