
ছবি সংগৃহীত
সন্তান হারাবার সীমাহীন শোকে ...
আপডেট: ২৫ মার্চ ২০১৩, ১১:১১
কথায় বলে– পৃথিবীতে সবচাইতে ভারী বোঝা হচ্ছে পিতার ঘাড়ে পুত্রের লাশ! রূপক অর্থে বলা বাক্য, যার অন্তর্নিহিত অর্থ এই যে পিতামাতার জন্য সন্তান হারাবার চাইতে বড় কষ্ট আর হতে পারে না। মৃত্যু... জগতের সবচাইতে নিশ্চিত ব্যাপার। মৃত্যু আসবেই, ঠেকবে না কোনও কিছুতে। পৃথিবীর কোনও জীবিত প্রাণীর সাধ্য নেই একে এড়িয়ে যাবার। জন্ম নিলে একটা না একটা সময় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হবেই- জগতের অবধারিত নিয়ম! তবুও কোনও বাবা মা সন্তানের মৃত্যু ভাবনাকে মনে স্থান দেন না, কখনো চিন্তাও করেন না এই একটি ব্যাপার নিয়ে। কিন্তু সন্তানেরা হারায়, আমাদের ঘর-জীবন আলোকিত করে রাখা প্রজাপতিরা জীবনের কোনও এক নিষ্ঠুর পরিহাসে সব ছেড়ে চলে যায় মৃত্যুলোকের ওপারে। চলে যায় আপনজনদের শোকের অন্ধকারে হারিয়ে রেখে। সত্যি বলতে কি, সন্তান হারাবার শোক নিয়ে কথা বলতে যাওয়াও এক ধরনের ধৃষ্টতা। সন্তানহারা পিতামাতা ব্যতীত আর কেউ কল্পনাও করতে পারবেন না যে কি অসহনীয় এই শোক, কি প্রবল-প্রচণ্ড এই ব্যথা। এক জীবনে ভোলা যায়না যে কষ্ট, এটা ঠিক তাই। অন্য মৃত্যুশোক গুলি হয়তো এক সময় সয়ে আসে প্রকৃতির নিয়মেই, কিন্তু সন্তান হারাবার শোক নয়। সন্তানকে হারিয়ে স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকা পর্যন্ত ছেড়ে দেন কত মা বাবা। দোষ তাদের দেয়া যায় না কিছুতেই। মানব জীবনের সব চাইতে মূল্যবান সম্পদ তো এই সন্তানই। অনেক সাধনায় মেলা সেই সম্পদ অকালে হারাবার ব্যথা সইবার ক্ষমতা না থাকাটাই খুব স্বাভাবিক। কিন্তু সইতে না পারলেও, মানতে হয়। সৃষ্টিকর্তার বিধান বলুন, কিংবা প্রকৃতির নিয়ম... মেনে আমাদের নিতেই হয়। আর মেনে নিয়ে বেঁচেও থাকতে হয়। রোগ- শোক- দুর্ঘটনা ইত্যাদি কত হাজারো বাহানায়, হাজারো চেহারায় নিয়ে উপস্থিত হয় মৃত্যু। তবে আপন মানুষ হারাবার বেদনা সকল ক্ষেত্রেই সমান, সকল মানুষের ক্ষেত্রে সমান। আর যদি যদি সেই আপন মানুষটি হয় নিজের সন্তান, তাহলে কষ্ট অতিক্রম করে যায় ভয়াবহতার সকল সীমারেখা। তবু আমাদের বাঁচতে হয়। জীবন সঙ্গীর মুখের দিকে তাকিয়ে, পরিবারের মুখের দিকে তাকিয়ে, আরও সন্তান থাকলে তাদের দিকে তাকিয়ে। ইচ্ছা না হলেও বাঁচতে হয়, জোর করে হলেও শিখে নিতে হয় বেঁচে থাকা। এই বেঁচে থাকার চেষ্টা নিয়েই আসুন আজ কথা বলি। উপদেশ নয় কোনমতেই, একজন সুহৃদের পরামর্শ কেবল। -প্রায় অর্ধেক ক্ষেত্রেই দেখা যাক সন্তান হারাবার পর ভেঙ্গে যায় শোকাহত দম্পতির সংসারও। পরিণাম হয় বিবাহ বিচ্ছেদ বা আলাদা বসবাস। সন্তান হারাবার ঝড়টা বয়ে যেতে না যেতেই বিচ্ছেদের অন্ধকার ছেয়ে ফেলে জীবন। এবং এর পেছনে কাজ করে পরস্পরকে দোষী ভাববার প্রবণতা। সন্তানের মৃত্যুর জন্য পরস্পরকে দোষ দিতে দিতেই ভেঙ্গে যায় দাম্পত্যের ভাঙ্গন। সঙ্গী/ সঙ্গিনীকে দোষ দেয়ার আগে ভাবুন, শিশুটি কি তারও সন্তান ছিল না? আপনি যেমন কষ্ট পাচ্ছেন, তিনিও তো পাচ্ছেন। কেন তিনই জেনে বুঝে নিজের সন্তানের ক্ষতি করতে চাইবেন? যে যাবার সে চলে গেছে, শত দোষারোপেও ফিরে আসবে না আপনার সন্তান। দোষারোপে পরস্পরের কষ্টই বাড়ছে শুধু, মূল কষ্টটা কিন্ত কম হচ্ছে না। -নিজেকে ধরে রাখবার চেষ্টা করুন পরিবারের মুখের দিকে তাকিয়ে। জীবন সঙ্গী মানুষটিও কষ্ট পাচ্ছেন, তাই আগে কম করবার চেষ্টা করুন সেই মানুষটির কষ্ট। তার ক্ষতে মমতার প্রলেপ দেয়ার চেষ্টা করুন। দেখবেন খুব আস্তে আস্তে হলেও আপনার কষ্ট কম হতে শুরু করেছে। -বেঁচে থাকার চেষ্টা করুন নিজের অন্য সন্তান কিংবা পরিবারের মানুষদের জন্য। হতে পারে আপনার জীবনসঙ্গী হিশাবে এই মুহূর্তে কেউ নেই, হয়তো নেই অন্য সন্তানও। হতে পারে বিধাতার নিষ্ঠুর নিয়মে নিজের একমাত্র সন্তানকে আপনি হারিয়ে ফেলেছেন। সেক্ষেত্রে নিজের সবচাইতে কাছের মানুষটিকে অবলম্বন হিশাবে আঁকড়ে ধরুন। আর যদি দুর্ভাগ্যক্রমে তেমন কেউও না থাকে, তাহলে আঁকড়ে ধরুন সন্তানের স্মৃতিকেই। মন দিয়ে ভেবে দেখুন, আপনাকে এমন দুঃখী আর বিষণ্ণ দেখলে কি খুশি হতো আপনার সন্তান? -তরুণ দম্পতি যারা দুর্ভাগ্যজনকভাবে হারিয়েছেন একমাত্র সন্তানকে, তারা চেষ্টা করুন আবার পিতা-মাতা হবার। আরেকটি সন্তানের আগমন অনেকটাই লাঘব করবে আপনার বুকের ভার, জীবনে আবার হাসি আনন্দ নিয়ে আসবে। -নিজ নিজ ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে থাকলে মেনে চলার চেষ্টা করুন ধর্মীয় অনুশাসন গুলো। মৃত মানুষের আত্মার শান্তির জন্য আপনার ধর্ম যা যা করবার পরামর্শ দেয়, সেটা অবশ্যই পালন করুন। দেখবেন নিজের মাঝে বেশ একটি শান্তি ফিরে পাবেন। মনে হবে যে এখনও সন্তানের জন্য কিছু করতে পারছেন আপনি। যদি এমন হয়ে থাকে যে আপনার সন্তানটি মারা গিয়েছে কোনও এক্সিডেন্টে, কিংবা খুন হয়েছে বা অন্য কোনও মানুষের সৃষ্ট কারণে মারা গিয়েছে, তাহলে চুপ করে থাকবেন না। তাতে আপনার কষ্ট আরও বাড়বে। আইনের আশ্রয় নিয়ে সন্তানের খুনীর বিচারের ব্যবস্থা করুন। কাজটা খুব কঠিন, খুব। কিন্তু সেটা না করা পর্যন্ত কিছুতেই শান্তি ফিরে আসবে না আপনার মনে। -প্রয়োজন বোধ করলে স্বামী- স্ত্রী দুজনেই কোনও একজন ভালো কাউন্সিলারের সাহায্য নিন। সম্ভব হলে সন্তানহারা অন্য দম্পতিদের সাথে নিজেদের অনুভব ভাগাভাগি করতে পারেন। একমাত্র তারাই আছেন, যারা আপনার বেদনা অনুধাবন করতে পারবেন। -স্মৃতি মুছে ভেলার চেষ্টা করবেন না, কিংবা ভুলে যাবারও। তাতে কষ্ট কেবল বাড়বেই। হতে পারে প্রাণপ্রিয় সন্তান হারিয়ে গেছে এই পৃথিবীর বুক ছেড়ে, কিন্তু সে আছে আপনাদের সাথেই। আপনাদের চিন্তা-চেতনা-ভাবনা- প্রাথর্নায়। তাকে ভুলে যাবার চেষ্টা না করে যত্ন করে সাজান স্মৃতির ডায়রিতে। সুন্দর মুহূর্তগুলোকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকবার লড়াই চালিয়ে যান। -সব চাইতে বড় চেষ্টা যেটা তা হলো- নিজেকে দোষ দিবেন না। হ্যাঁ, আপনার বারবার মনে হবে যে হয়তো আরও অনেক কিছু করা যেত। হয়তো এটা করলে সে বেঁচে থাকতো, হয়ত ওটা করলে বাঁচানো যেত তাকে, হয়ত সেটা করলে কিছুতেই উপস্থিত হতো না এই দিন... ইত্যাদি হাজারো জিনিশ মনে হবে আপনার বারবার। আর নিজেকে কেবল দোষী মনে হবে। মনে হবে যে আপনি আপনার সাধ্য মতন চেষ্টা করেননি। কিন্তু বাস্তবতা এটাই যে, কোনও চেষ্টাতেই লাভ হতো না। বিধাতার যা বিধান ছিল তাই হয়েছে। এবং আপনি আপনার সাধ্যমত সকল চেষ্টা করেছেন। নিজেকে দোষ দিয়ে আপনি বিধাতার বিধান বদলাতে পারবেন না কিছুতেই। বিধাতার নিয়মের বাইরে যাবার ক্ষমতা আমাদের কারো নেই। তবু হয়তো একটু বাড়তি যত্ন, একটু বাড়তি মমতা, বাড়তি সচেতনতা আমাদের রক্ষা করতে পারে জীবনে অনাখাঙ্খিত অনেক দুর্ঘটনা থেকে। মৃত্যু আসবেই, কিন্তু অকাল মৃত্যু কখনো কাম্য নয়। যত্নে থাকুক আপনার সন্তান, ভালো থাকুন আপনি... এটাই সর্বদা কাম্য। তবু একটি অন্ধকার ঘটনা যদি ঘতেই যায়, জীবন যদি দাঁড় করিয়েই দেয় আপনাকে সন্তান হারাবার বিপুল শোকের সামনে... সেক্ষেত্রে একটিই অণুরোধ- একটু সময় দিন নিজেকে। সময় দিন প্রকৃতিকে আপনার ক্ষত পূরণ করবার। নিজের জন্য না হোক, যে চলে গেছে তার জন্য বেঁচে থাকুন। মৃত্যু মানেই ফুরিয়ে যাওয়া নয়। হারিয়ে ফেলা মানুষটির জন্য যা যা করা সম্ভব, করুন। আপনার সেই চেষ্টা একভাবে না একভাবে ঠিকই গিয়ে পৌঁছাবে তার কাছে। এমন ভীষণ কষ্টের দিন না আসুক কারো জীবনে, সেই প্রাথর্না সকলের জন্য।