কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

ছবি সংগৃহীত

শহীদুল জহির-এর ছোট গল্প “কাঁটা”-- সাম্প্রদায়িকতার কুয়ো ও অপরাধ বোধের কাঁটা।

Sabuj Wahid
লেখক
প্রকাশিত: ১৮ মে ২০১৩, ১৭:৩৫
আপডেট: ১৮ মে ২০১৩, ১৭:৩৫

বড় ভাই স্থানীয় এক দাদা (সনাতন ধর্মালম্বী) হঠাৎ-ই দেশ ছাড়বার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ঘটনাটা জানবার পর চমকে উঠলাম। দাদার সাথে দেখা করে জানতে চাইলাম, কেন নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যেতে চাচ্ছেন?’ দাদা দু’টি কারণ দেখালেন। প্রথমটি অর্থনৈতিক। এখানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হাড়ভাঙা খাটুনি খেটেও ঠিক কুলিয়ে উঠতে পারছেন না (অবশ্য এমনও নয় যে, পাশ্ববর্তী দেশে দেশান্তরী হলে তাঁর এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বরং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরো খারাপ হবার সম্ভাবনাই প্রবল)... যাই হোক, বিষয়টা সম্ভাব্য কী কী ভাবে কাটিয়ে ওঠা যেতে পারে সে বিষয়ে আলোচনা করলাম তাঁর সাথে। পরের কারণটা রাজনৈতিক; তাঁর ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে এ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির মোচড়গুলি ঠিক আশ্বস্ত করতে পারছে না তাকে। শুনে বলতে গেলাম, দাদা, চিন্তা করেন না, কিছু হবে না, আমরা আছি... গলার স্বর মাঝ পথে ক্ষীণ হয়ে গেল। আচমকা-ই মনে হলো কোন এক দূর অতীত থেকে এই কথাগুলি-ই বিলাপের মতন স্বরে হাওয়ায় ভেসে ভেসে আমার কানে আসছে। আমার আগেও কারা যেন এমন সব পরিস্থিতিতে এই কথাগুলি-ই বলে ফেলেছে; এবং তাঁরা থেকেও না থাকবার বা না থাকতে পারার অপরাধ বোধের বেদনায় এখনো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চলেছে। তাঁরা কারা? তাঁরা ঢাকা শহরের ভূতের গলির লোকজন; যাদের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে সুলেখক শহীদুল জহির (জন্মঃ ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৫৩ - মৃত্যুঃ ২৩ মার্চ ২০০৮)-এর মাধ্যমে। শহীদুল জহির তাঁর অসাধারণ গল্পগ্রন্থ “ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প”-এর অন্তর্গত “কাঁটা” নামক দুর্দান্ত গল্পটির মাধম্যে আমাকে এমন ঘটনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। গল্পে দেখা যায় যে, সময়ের কাঠামো ভেঙে দিশেহারা ভূতের গলির লোকেদের অতীত ও বর্তমান এলোমেলো হয়ে যায় যখন এ গলির আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বাড়িতে ভাড়াটে হয়ে আসে সুবোধচন্দ্র ও তাঁর স্ত্রী স্বপ্না। এই ভাড়াটে দম্পতিকে দেখে ভূতের গলির লোকেদের মনে সংশয় জাগে যে, সুবোধচন্দ্র ও তাঁর স্ত্রী না আবার আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বাড়ির উঠোনে থাকা কুয়োতে (যে কুয়ো তাঁরা এখনো বন্ধ করতে পারেনি) পড়ে যায়! কারণ তাদের অতীত তাদেরকে এ ভয়ে ভীত হতে বাধ্য করে। তাদের মনে পড়ে যায়, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বাড়িতে ভাড়াটে হিসেবে ছিলো সুবোধচন্দ্র ও স্বপ্না রানী দম্পতি। যুদ্ধকালে সারা বাংলাদেশ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আর তাদের দোসর রাজাকার, আল বদররা ছেঁয়ে ফেলতে ফেলতে ভূতের গলিতে এসে উপস্থিত হলে সুবোধচন্দ্র বিচলিত বোধ করতে থাকলে ভূতের গলির লোকেরা তাকে সাহস দিয়ে বলে, ‘আমরা আছি না, আমরা মইরা গেছি নিহি’ এবং ঘটনা পরম্পরায় তাঁরা বার বার সুবোধচন্দ্রকে এই কথা বলে আশ্বস্ত করতে চায়। হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পাবার আশায় সে ও তাঁর স্ত্রী নিজস্ব ধর্মীয় চিহ্ন মুছে মুসলমান সাজে। কিন্তু বিধিবাম; রাজাকার বাহিনীর স্থানীয় কমান্ডার আবুবকর মওলানার কূট তৎপরতায় পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে সুবোধচন্দ্রের ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা দেখা দেয় যখন গলির সকল পুরুষকে নগ্ন করে লিঙ্গ পরীক্ষার সম্মুখীন করা হয়। এ রকম সময়ে সুবোধচন্দ্র আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বাড়ির উঠোনে থাকা কুয়োর ভেতর পড়ে যায় বা তাকে ফেলে দেয়া হয়; এবং স্বপ্না রানীও স্বামীর সাথে সহমরণে যাবার জন্য কুয়োতে ঝাপ দেয় বা তাকেও ফেলে দেয়া হয়। যুদ্ধ শেষ হলে সাতক্ষীরা থেকে সুবোধচন্দ্রের ভাই পরানচন্দ্র এসে ভাই ও বৌদির মৃত্যুর খবর জানতে পারে এবং কিছু স্মুতি চিহ্ন নিয়ে ফিরে যায়। এবং তার পর আবার এক বার (লেখক এখানে সময়টা নির্দিষ্ট করে দেননি; তবে গল্পে শেষ বার সুবোধচন্দ্র ও স্বপ্না রানী কুয়োতে পড়ে যাবার বছর সাতেক আগে) সুবোধচন্দ্র ও স্বপ্না রানী ওই একই কুয়োর ভেতর পড়ে যায়। এই বার কুয়োর ভেতরে তাঁদের পড়ে যাবার কারণ নির্দিষ্ট করে জানা যায় না; তবে লোকমুখে এটুকু শোনা যায় যে, “সেসময় ঢাকা শহরের কোনো কোনো এলাকায় দাঙ্গা হওয়ার খবর পাওয়া যায়।” এবার লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে যে, সুবোধচন্দ্র ও তাঁর স্ত্রী স্বপ্না কুয়োর পাড়ে বসে পূর্ণিমা দেখবার সময় কুয়োর পানিতে চাঁদের প্রতিবিম্ব লক্ষ্য করে এবং এই প্রতিবিম্ব ছুঁয়ে দেখতে গিয়ে কুয়োর মধ্যে পড়ে এবং মারা যায়। এবার নারায়ণগঞ্জ থেকে সুবোধচন্দ্রের ছোট ভাই পরানচন্দ্র এসে দাদা-বৌদির লাশ নিয়ে যায়। লেখক সরাসরি না দেখালেও এটুকু ইঙ্গিত দিয়ে দেন যে, এবার সুবোধচন্দ্র ও স্বপ্না রানীর কুয়োতে পড়ে যাবার পেছনে ওই দাঙ্গা একটা কারণ হতে পারে। এই ঘটনার সাত বছর পর দেশে যখন ‘নিঃসন্তান রংবাজ জেনারেলের শাসনকালের শেষদিকে মহাবন্যার পরের কোনো এক সময়’ সুবোধচন্দ্র দম্পতিকে আবার ভূতের গলির আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বাড়িতে ভাড়াটে হিসেবে পাওয়া যায়। এ সময় একদিন ভূতের গলির লোকেরা অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলবার ঘটনাটি জানতে পারে। ঘটনা জেনে সুবোধচন্দ্র ভয়ে ভয়ে থাকে এবং জনসমক্ষে ম্লান মুখে বলে, ‘এইগুলা কোনো কাম না, মসজিদ ভাঙলেই কি ধর্ম হয়?’ বস্তুত ভূতের গলির লোকেরা সুবোধচন্দ্রের ভয় পাবার বিষয়টি বুঝতে পারে এবং তাকে যথা সাধ্য অভয় দেবার চেষ্টাও করে। কিন্তু তখনি একদিন জানা যায় যে, সুবোধচন্দ্র নাকি মসজিদ ভাঙার খবর শুনে মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি কিনে এনে স্ত্রীকে নিয়ে খেয়েছে। কিন্তু “এই মিষ্টি খাওয়ার ঘটনা কে দেখে কিংবা এই ঘটনার কথা কার কাছ থেকে জানা যায় তা মহল্লার লোকেরা বলতে পারে না।” মহল্লার লোকেরা এই কথা শুনে ক্ষিপ্ত হয় এবং ভাবনা-চিন্তা করে উঠবার আগেই গিয়ে সুবোধচন্দ্রের আবাসে হাজির হয়। তাঁরা ফিরে যাবার পর সুবোধচন্দ্র ও তাঁর স্ত্রী স্বপ্নার লাশ কুয়োর ভেতরে পাওয়া যায়। এবার পুলিশ এসে লাশ নিয়ে যায়। এ ঘটনা ঘটাবার পর মহল্লার লোকেদের ঘুরেফিরে বার বার সকল স্বপ্না রানীর হাতে তৈরী নিমকপারা ও চা খাবার কথা মনে পড়ে; মনে পড়ে বার বার সকল সুবোধচন্দ্রকে দেয়া অভয় বাণী এবং তা রাখতে ব্যর্থ হবার কথাও। এ সকল বিষয়গুলি ক্রমাগত তাদেরকে বিষন্নতা ও অপরাধ বোধে বিদ্ধ করতে থাকলে তাদের সময়ের কাঠামোটি ভেঙে পড়ে। তাঁরা কুয়োটি বুজিয়ে ফেলবার চেষ্টা করে এবং হয়তো বা বুজিয়ে ফেলতেও পারে; কিন্তু সে নিশ্চয়তা গল্পের শেষে এসেও ঠিক পাওয়া যায় না। ধর্মীয়-সাম্প্রদায়িকতা নামক এক ভয়ংকর কুৎসিত দানবের মুখ হয়ে খোলা থাকা ওই কুয়ো যে এখনো বন্ধ করা যায়নি; গল্পের বাইরে এসে এটা আমরা টের পাই সেনা শাসনমুক্ত দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবার এক দশক পরও নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার সময়। তার পর আবার মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের অত্যাচারিত হবার খবরে এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অপরাধীদের শাস্তি হলে কোনো এক অপরাধীর মুখ চাঁদে দেখা যাচ্ছে এমন গুজব প্রচারের পর; এ সময় সুবোধচন্দ্র ও স্বপ্না রানীরা আবার ওই কুয়োতে পড়ে যায়। এই কুয়োতে পড়ে যাবার সম্ভাবনায় ভীত হয়ে আমার আত্মার সম্পর্কে আত্মীয় ওই দাদা হৃদয় ভাঙার শব্দ দীর্ঘশ্বাসে ঢেকে যখন দেশ ছাড়বার সিদ্ধান্তের কথা জানান তখন তাকে সাহস দিতে গিয়েও কন্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসে; কারণ-- ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে ভরা ওই কুয়োর মুখ আজো হাট করে খোলা; আমরা যারা এই অপরাধ বোধের কাঁটা অন্তরে বিঁধে থাকবার যন্ত্রণায় ছটফট করে চলি প্রতিনিয়ত তাঁরাও সেই খোলা মুখ বুজিয়ে ফেলতে পারিনি; এখনো! এবং এখনো...