ছবি সংগৃহীত

লাইলাতুল মিরাজ : মিরাজের অলৌকিক ঘটনাবলি

priyo.Islam
লেখক
প্রকাশিত: ২৬ মে ২০১৪, ০৬:৪৭
আপডেট: ২৬ মে ২০১৪, ০৬:৪৭

দুনিয়া ও আখিরাতের ডাক এবং নবীদের সালাম : মিরাজের রাতে বহু অলৌকিক ঘটনা ঘটে। আমরা হাদিস থেকে বিষয়গুলো তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছি। আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, যখন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে জিবরাইল (আ.) বোরাক নিয়ে এলেন, তখন বোরাকটি তার লেজ নাড়া দিল। জিবরাইল (আ.) বললেন, থামো, নড়াচড়া করো না, আল্লাহর কসম! তোমার ওপর তাঁর মতো আযীমুশ্শান আরোহী কখনো আরোহণ করেনি। এরপর রাসুলুল্লাহ (সা.) তার ওপর উঠে চলতে লাগলেন, হঠাৎ পথের একপাশ্র্বে একজন বৃদ্ধা নারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটল। তখন তিনি বললেন, হে জিবরাইল এ বৃদ্ধা কে? তখন তিনি বললেন, হে মুহাম্মদ (সা.) আপনি চলতে থাকুন। এরপর যতক্ষণ আল্লাহর ইচ্ছা তিনি চলতে লাগলেন, হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন পথের একপাশ্র্বে কোনো বস্তু তাকে ডাকছে। তখন হজরত জিবরাইল বললেন, আপনি সফর অব্যাহত রাখুন। রাসুলুল্লাহ (সা.) যতক্ষণ আল্লাহর ইচ্ছা চলতে লাগলেন। এরপর আল্লাহর একপ্রকার সৃষ্টজীব তাঁকে সম্বোধন করে বলল, আসসালামু আলাইকা ইয়া আউয়াল (হে প্রথম! আপনার প্রতি সালাম)। আসসালামু আলাইকা ইয়া আখির (হে শেষ! আপনার প্রতি সালাম)। আসসালামু আলাইকা ইয়া হাশিরা (হে সমবেতকারী! আপনার প্রতি সালাম)। তখন হজরত জিবরাইল (আ.) বললেন, এর জবাব দান করুন। তিনি জবাব দিলেন। দ্বিতীয়বার তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তখনো তারা অনুরূপ সালাম করল। তৃতীয়বারও তারা অনুরূপ বলল, এভাবে তিনি বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত পৌঁছে গেলেন। সেখানে তাঁর সামনে মদ, পানি ও দুধ আনা হলো। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সা.) দুধ গ্রহণ করলেন। তখন জিবরাইল (আ.) বললেন, আপনি ফিৎরাতকে লাভ করেছেন (সঠিক পথাবলম্বন করেছেন)। যদি আপনি পানি পান করতেন তবে আপনার উম্মত ডুবে মরত। আর যদি আপনি মদ পান করতেন তবে আপনার উম্মত ভ্রান্ত হয়ে পড়ত আর আপনিও ভ্রান্ত হতেন। এরপর আদম (আ.) থেকে রাসুলুল্লাহ (সা.) পর্যন্ত সব নবীকে সেখানে পাঠানো হলো এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) সে রাতে তাদের সবার ইমামতি করলেন। এরপর জিবরাইল (আ.) বললেন, পথে যে বৃদ্ধা নারীকে দেখতে পেয়েছেন, সেটা হলো, এই পৃথিবীর বয়স, এখন ততটুকু বাকি আছে যতটুকু এই বুড়ো মহিলাটির আছে। আর পথের পাশে যাকে আহ্বান করতে দেখেছেন, সে হলো আল্লাহর দুশমন ইবলিস। আপনাকে তার প্রতি আকৃষ্ট করাই তার উদ্দেশ্য ছিল। আর পথে যাঁদের আপনি সালাম করতে দেখেছেন, তাঁরা হলেন, হজরত ইবরাহীম, মূসা ও ঈসা (আ.)। হাফিজ বায়হাকি ইবনে ওয়াহবের সূত্রে হাদিসটি দালায়েলুন্নবুওয়াত গ্রন্থে এরকমই বর্ণনা করেছেন। গীবতকারীদের পরিণতি দর্শন : ইমাম আহমদ অন্য সূত্রে হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তায়ালা যখন আমাকে মি'রাজ করলেন, তখন আমি এমন এক সম্প্রদায়ের কাছ দিয়ে অতিক্রম করলাম, যাদের নখগুলো তামার তৈরি এবং তা দিয়ে তারা নিজের মুখমণ্ডল ও বুকে জখম করেছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, "হে জিবরাইল! এরা কারা?" তিনি বললেন, এরা হলো, সেসব লোক, যারা মানুষের মাংস ভক্ষণ করত অর্থাৎ মানুষের অনুপস্থিতিতে তাদের নিন্দাবাদ (গীবত) করত এবং তাদের মানসম্ভ্রম নষ্ট করতে চেষ্টা করত। ফেরাউনের কন্যার চিরুনির সুগন্ধি : ইমাম বায়হাকি বলেন, আলী ইবনে আহমদ ইবনে আব্দুল্লাহ হজরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করছেন, মি'রাজের রাতে আমার কাছে দিয়ে একটি সুগন্ধি ছড়িয়ে গেল, আমি জিজ্ঞাসা করলাম এটি কিসের সুগন্ধি? জিবরাইল (আ.) বললেন, এটা ফিরাউনের মেয়ে ও তার সন্তানের চিরুনির সুগন্ধি। একবার তার হাত থেকে চিরুনি পড়ে গেলে তিনি অনিচ্ছায় বিসমিল্লাহ বলে উঠালেন। এরপর ফিরআউনের অন্য মেয়ে বলল, আল্লাহ তো আমার পিতা, কিন্তু তিনি বললেন, আমার প্রতিপালক, তোমার প্রতিপালক ও তোমার পিতা ফিরআউনের প্রতিপালক কেবল আল্লাহ। তখন আরেক মেয়ে বলল, আমার পিতা ছাড়া কি তোমার অন্য কোনো প্রতিপালক আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমার প্রতিপালক, তোমার প্রতিপালক ও তোমার পিতার প্রতিপালক কেবল আল্লাহ। এ সংবাদ ফিরআউনের কাছে পৌঁছে গেলে সে তাকে ডেকে জিজ্ঞাস করল, আমি ছাড়া তোমার অন্য কোনো প্রতিপালক আছে কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমার ও আপনার প্রতিপালক কেবল আল্লাহ। এরপর ফিরআউন তামার গাভী গরম করতে আদেশ করল, এতে তাকে ও তার সন্তানদের নিক্ষেপ করে প্রাণনাশের নির্দেশ দিল। তখন ফিরআউনের মেয়ে বললেন, আমার একটি অনুরোধ রক্ষা করুন, ফিরআউন জিজ্ঞাসা করল, তোমার কী অনুরোধ। তিনি বললেন, আমার ও আমার সন্তানের জীবননাশের পর আমাদের সবার হাড্ডিগুলো একই স্থানে রেখে দেবেন। ফিরআউন বলল, যেহেতু আমার ওপর তোমার কিছু হক রয়েছে, সুতরাং তোমার এ অনুরোধ রক্ষা করা হবে। এরপর তাদের উত্তপ্ত তামার গাভীর মধ্যে এক এক করে নিক্ষেপ করা হলো। অবশেষে যখন তার দুগ্ধপোষ্য শিশুকে নিক্ষেপ করার সময় এলো তখন সে তার মাকে ডেকে বলল মা! আপনি অনুতাপ করবেন না, আপনি বিচলিত হবেন না এবং এ পথে জীবন দিতে আপনি দ্বিধা করবেন না। কারণ আপনি সত্যের ওপর আছেন আর এই যে সুগন্ধি আসছে, এটা তাদের বেহেশতের বাসস্থান থেকে বের হচ্ছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, চারটি শিশু শৈশবেই কথা বলেছে। এই শিশু, হজরত ইউসুফ (আ.)-এর পক্ষে সাক্ষ্য দানকারী শিশু জুরাইজ এর পক্ষে সাক্ষ্য দানকারী শিশু এবং হজরত ঈসা (আ.)। দৃষ্টির সামনে মসজিদে আকসার দৃশ্য পেশ : ইমাম আহমদ (রা.) বলেন, মুহাম্মদ ইবন জা'ফর ও রওহ্ ইবনে মা'লী হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন, মি'রাজ শেষে যখন আমি মক্কায় ফিরলাম তখন আমার ধারণা হলো, এ ঘটনা বর্ণনা করলে মানুষ আমাকে মিথ্যাবাদী বলবে এবং তারা এটা অস্বীকার করবে। এরপর রাসুলুল্লাহ (সা.) চিন্তিত হয়ে বসে থাকলেন। আল্লাহর দুশমন আবু জেহেল তার কাছ দিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে দেখে তাঁর কাছে গিয়ে বসল। এবং বিদ্রূপস্বরে সে তাঁকে জিজ্ঞাস করল ওহে, তোমার নতুন কিছু হয়েছে কি? রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে বললেন হ্যাঁ, সে জিজ্ঞাসা করল কী হয়েছে? রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, রাতে আমাকে ভ্রমণ করান হয়েছে। সে জিজ্ঞাসা করল কোন পর্যন্ত? তিনি বললেন বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত। আবু জেহেল বলল, বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত ভ্রমণ করে আবার তুমি আমাদের মধ্যে ফিরে এসেছ? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন সে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কথাকে অস্বীকার করা সমীচীন মনে করল না, কারণ তার আশঙ্কা হলো, মানুষের সমাবেশে হয়তো তিনি এ কথা অস্বীকার করে ফেলবে। তখন সে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, আমি যদি তোমার কওমকে ডেকে একত্র করি তবে তাদের সামনেও কি তুমি এ কথা বলবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন সে উচ্চস্বরে ডাক ছাড়ল, হে বনু কা'ব ইবনে লুওয়াই গোত্রের লোকেরা! তার এ চিৎকার শুনতেই সবাই সেখানে জড়ো হলো। আবু জেহেল বলল, তুমি আমাকে যে কথা বলেছ, এখন সবার সামনে তা বলো। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমাকে রাতে ভ্রমণ করান হয়েছে। তারা জিজ্ঞাসা করল কোন পর্যন্ত? তিনি বললেন, বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত। তারা বলল, বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত ভ্রমণ করে আবার তুমি আমাদের মাঝে ফিরে এসেছ? তিনি বললেন হ্যাঁ। এ কথা শুনে বিস্ময়াভিভূত হয়ে কেউ কেউ তালি বাজাতে লাগল আর কেউ কেউ মিথ্যা কথা মনে করে মাথায় হাত দিয়ে বলল, আচ্ছা তুমি কি বাইতুল মুকাদ্দাসের কিছু অবস্থা বলতে পার? তাদের মধ্যে কিছু লোক এমন ছিল যারা বাইতুল মুকাদ্দাস ভ্রমণ করেছে এবং মসজিদও দেখেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমি বাইতুল মুকাদ্দাসের বর্ণনা দিতে লাগলাম কিন্তু কিছু কিছু বিষয়ে আমার সন্দেহ হতে লাগল। আল্লাহ তায়ালা আপন কুদরতে বাইতুল মুকাদ্দাসকে আমার সামনে হাজির করে দিলেন এবং তাকে আকীলের ঘরের কাছে রেখে দিলেন আর আমি তা দেখে দেখে তার অবস্থা বর্ণনা করতে লাগলাম। এ ব্যবস্থা এ কারণে করা হয়েছিল যে মসজিদের কোনো কোনো অবস্থা আমার মনে ছিল না। তখন তারা বলল, আল্লাহর কসম! মুহাম্মদ (সা.) তো বাইতুল মুকাদ্দাসের সব অবস্থা ঠিক ঠিক বর্ণনা করেছে। ইমাম নাসায়ী আওফ ইবনে আবূ জামীলা হতে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। আকসা মসজিদের গেট আটকে যাওয়া : হাফিয আবু নু'আইম ইস্পাহানি দালায়েলুন্নবুয়ত গ্রন্থে মুহম্মদ ইবনে উমর ওয়াকেদী মুহাম্মদ ইবনে কা'ব কুরাযী হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) রোম সম্রাট হিরাকলের কাছে হজরত দাহ্ইয়া কালবীকে দূত হিসেবে প্রেরণ করলেন। তিনি হিরাকলের কাছে পৌঁছলেন। এরপর হিরাকলে সিরিয়ায় অবস্থানরত আরবের ব্যবসায়ীদের ডাকলেন। আবু সুফিয়ান দুখর ইবনে হারবকে ও সঙ্গীদের হাজির করা হলো। এরপর তিনি সেসব প্রশ্ন করলেন, যার উল্লেখ বুখারি ও মুসলিম শরিফে রয়েছে। আবুসুফিয়ান হিরাকলের সামনে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে হেয়প্রতিপন্ন করতে প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন। তিনি নিজেই বলেন, আল্লাহর কসম, হিরাকলের সামনে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে হেয়প্রতিপন্নকারী কোনো কথা বলতে এই ভয় ছাড়া অন্য কোনো জিনিস আমাকে বাধা দেয়নি যে হয়তো তার সামনে আমার মিথ্যা ধরা পড়ে যাবে এবং তার কাছে আমার আর কোনো কথাই গ্রহণযোগ্য হবে না। এমন সময় হঠাৎ তার মি'রাজের কথাটি আমার মনে পড়ল, এবং বললাম, সম্রাট! আপনাকে আমি এমন একটি খবর কি দেব না, যা আপনার কাছে তার মিথ্যা প্রমাণিত হবে? তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, সেটা কি? তিনি বললেন, তখন আমি বললাম, তিনি বলেছেন, তিনি আমাদের ভূখণ্ড মসজিদুল হারাম থেকে আপনাদের মসজিদে ইলীয়া পর্যন্ত একই রাতে ভ্রমণ করে ভোর হওয়ার আগেই ফিরে গেছেন। আবু সুফিয়ান বলেন, আমার কথা শোনামাত্রই বায়তুল মুকাদ্দিসের পাদরী বলে উঠলেন, এটা সম্পূর্ণ সত্য। তখন রোম সম্রাট কায়সার তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি এটা কিভাবে জানেন? তিনি বললেন আমি মসজিদের দরজাগুলো বন্ধ করার আগে ঘুমাতে যাই না। কিন্তু সেই রাতে একটি দরজা ছাড়া সব দরজা আমি বন্ধ করে দিই। কিন্তু ওই দরজাটি আমি কোনোভাবেই বন্ধ করতে পারিনি। তখন আমি আমার অন্যান্য কর্মচারী ও উপস্থিত লোকজনের সাহায্য নিলাম। কিন্তু সবাই জোর খাটিয়েও দরজাকে তার স্থান থেকে সরাতে পারল না। যেন কোনো পাহাড় সরাচ্ছি বলে মনে হলো। আমি কাঠমিস্ত্রি ডাকলাম, তারাও এটা খুব লক্ষ করে দেখল কিন্তু কোনো উপায়েই তা সরাতে পারিনি এবং সকাল পর্যন্ত মুলতবি রইল। পাদরী বলেন, আমি দরজাটি খোলাই রেখে দিলাম। ভোরে যখন দরজার কাছে এলাম তখন মসজিদের পাশে পড়া পাথরটিতে ছিদ্র দেখলাম এবং এতে কোনো পশু বাঁধার চিহ্নও দেখতে পেলাম। তখন আমি আমার সাথিদের বললাম, আজ রাতে কোনো নবীর আগমনের জন্যই দরজাটি খোলা রাখা হয়েছিল এবং এই মসজিদে অবশ্যই তিনি নামাজ পড়েছেন। সূত্র : ইবনে কাছির সম্পাদনা : মাওলানা মিরাজ রহমান সৌজন্যে : দৈনিক কালের কণ্ঠ