ছবি সংগৃহীত

বিশ্বখ্যাত দাবাড়ু রানী হামিদ

আফসানা সুমী
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ৩০ জানুয়ারি ২০১৬, ১৫:২৬
আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৬, ১৫:২৬

ফটোসোর্স:commons.wikimedia.org

(প্রিয়.কম) দাবাড়ু রানী হামিদের নাম জানি না এমন কেউ নিশ্চয়ই এদেশে নেই। দাবার জন্যই যেন তার জন্ম। দাবাই তার ধ্যান, দাবাই জীবন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম মহিলা আন্তর্জাতিক দাবা মাস্টার।  রাণী হামিদের পুরো নাম সৈয়দা জসিমুন্নেসা খাতুন ডাক নাম রাণী। বিয়ের পর তিনি স্বামীর নাম যুক্ত করে রাণী হামিদ হন।  

ক্রীড়াজগতে তিনি রাণী হামিদ নামেই পরিচিত। ১৯৮৫ সালে তিনি ফিদে আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার খেতাব পান। তিনি ৩ বার ব্রিটিশ মহিলা দাবা প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হন। ব্রিটিশ মহিলা দাবায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, 'ব্রিটিশরা আমাদের অনেকদিন শাসন করেছে। সেই ব্রিটিশদের হারিয়েই আমি চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। পরে আরও দু'বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছি ওই আসরে।'  

রানী জাতীয় মহিলা দাবায় চ্যাম্পিয়ন হন ১৮ বার। যদিও ১৯৭৭, ১৯৭৮ ও ১৯৭৯ সালে আরো ৩ বার জাতীয় মাহিলা দাবায় জেতেন তিনি, কিন্তু তখন রেকর্ড রাখা হত না।

অসাধারণ প্রতিভাময়ী রানী হামিদের জন্ম ১৯৪৪ সালে সিলেট জেলার সৈয়দ পরিবারে। শৈশব থেকে দাবার বোর্ডের দিকে দারুণ ঝোঁক ছিল রানী হামিদের। ঝোঁকটা আরও বেড়ে গেল যখন দেখলেন, বাবা মমতাজ আলী প্রতি সন্ধ্যায় বন্ধুদের নিয়ে দাবা খেলতেন। স্কুলজীবনে ভাল ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় ও এ্যাথলেট হওয়া সত্ত্বেও দাবাই ছিল রানীর প্রধান ভালবাসা। ১৯৫৯ সালে তিনি সেনাবাহিনীর তৎকালীন বিশিষ্ট ক্রীড়াবিদ ক্যাপ্টেন আবদুল হামিদের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। স্বামী ক্রীড়াবিদ হওয়ায় দাবা খেলার ব্যাপারে সব ধরনের সহযোগিতা পান। ১৯৭৭ সাল থেকে এই পর্যন্ত সব ধরনের প্রতিযোগিতামূলক আসরে অংশ নিয়ে আসছেন রানী হামিদ। শুরুতে তিনি খুব এ্যাটাকিং খেলোয়াড় ছিলেন। পরে পজিশনাল খেলার দিকে নজর দেন।    

ঢাকার নবদিগন্ত সংসদের এসএ মহসিন স্মৃতি দাবা প্রতিযোগিতায় রানী হামিদ প্রথমবারের মতো খেলতে নেমে চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করেন। এই সাফল্যে তার উৎসাহ অনেক বেড়ে যায়। শুরু হয় তাঁর কঠোর অনুশীলন। খেলতে থাকেন বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়। দেশে তখনও জাতীয় পর্যায়ে মহিলা দাবা প্রতিযোগিতা শুরু হয়নি। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের প্রথম মহিলা জাতীয় দাবা প্রতিযোগিতার আসর অনুষ্ঠিত হয়। অনেকের মতো সেখানে নাম লেখান রানী হামিদ। সেখানেও চমক দেখান তিনি।

একবার-দু'বার নয়, এক এক করে পর পর টানা (১৯৭৯-১৯৮৪ সাল) টানা ছয় বার জাতীয় মহিলা দাবায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে এক অসামান্য রেকর্ড সৃষ্টি করেন তিনি। তাঁর পরের দুই বছর (১৯৮৫ ও ১৯৮৬ সালে) ইয়াসমিন বেগম রানী হামিদের আধিপত্যকে কিছুটা খর্ব করলেও পরের বছর (১৯৮৮ সালে) রানী হামিদ তাঁর শিরোপা ফিরে পান। এরপর আবারও এক বছরের জন্য (১৯৮৯ সালে) সৈয়দা শাবানা পারভিন নীপার কাছে শিরোপা গেলেও আবার রানী সেটা পুনরুদ্ধার করেন। কিন্তু এর পরের বছর আবার নতুন দাবা প্রতিভা তনিমা পারভিনের দখলে শিরোপা চলে গেলে রানী হামিদ কিছুটা দমে যান। কিন্তু পরের বছর আবার সেটা পেয়ে যান (১৯৯২ সালে)। তারপর আবার টানা কয়েক বছর পরে ১৯৯৬ সালে আবার চ্যাম্পিয়ন হন। 

 
মজার ব্যাপার হলো ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত এক বছর অন্তর অন্তর রানী হামিদ জাতীয় মহিলা দাবায় চ্যাম্পিয়ন হন। ইয়াসমিন, নীপা, তনিমারা দাবা অঙ্গন থেকে হারিয়ে গেছেন। কিন্তু রানী এখনও সমান তালে পাল্লা দিচ্ছেন লিজা-ইভা-শিরিন... ক্ষুদে তানিদের সঙ্গে।  

জাতীয় মহিলা দাবার পাশাপাশি জাতীয় দাবাতেও রয়েছে রানী হামিদের উজ্জ্বল উপস্থিতি। জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে মহিলা দাবাড়ুদের মধ্যে রানী হামিদই একাধিকবার খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। দাবা ক্রীড়াঙ্গনের এই নক্ষত্র তাঁর সাফল্যকে শুধু দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। দেশের বাইরেও রানী হামিদের নাম অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। এক অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়ে তিনি ব্রিটিশ মহিলা দাবায় তিনবার চ্যাম্পিয়ন (১৯৮৩, ১৯৮৫ ও ১৯৮৯ সাল) হবার বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেন। সেই সঙ্গে উপমহাদেশের সেকালের বিশ্বখ্যাত দাবা খেলোয়াড় গ্রেট মীর সুলতান খানের ত্রিশ দশকের রেকর্ডটিও স্পর্শ করেন। এছাড়া ব্রিটিশ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে একবার, লয়েড ব্যাঙ্ক মাস্টার্স দাবায় একবার ও বিশ্বদাবা জোনাল চ্যাম্পিয়নশিপে একবার রানার্স আপ হবার কৃতিত্ব দেখান। শহীদ মুফতি কাসেদ আনত্মর্জাতিক দাবা, সার্ক এয়ারলাইন্স দাবা ও এশিয়ান সিটি চেস চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হবার কৃতিত্ব দেখান তিনি। ১৯৮৪ সালে আন্তর্জাতিক দাবা ফেডারেশন থেকে 'ফিদে' খেতাব অর্জন করেন। 
 
সর্বশেষ, কমনওয়েলথ দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ-২০১৫ তে স্বর্ণ পদক লাভ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের নাম আবারো উজ্জ্বল করেন তিনি। 
 
রানী হামিদ একাধিকবার বিশ্ব দাবা অলিম্পিয়াডে শুধু মহিলা দল নয়, জাতীয় দলের হয়ে অংশ নেবার যোগ্যতা লাভ করেছেন। যে কৃতিত্ব বিশ্বের খুব কম মহিলা দাবাড়ুরই রয়েছে। স্বীয় অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি 'মজার খেলা দাবা' ও 'দাবা খেলার আইন কানুন' নামে দু'টি বই লিখেছেন।
 
লিখেছেন
আফসানা সুমী
ফিচার রাইটার, প্রিয় লাইফ
প্রিয়.কম