ছবি সংগৃহীত

জাপানের ধর্মীয় বৈচিত্র্য

প্রবীর বিকাশ সরকার
লেখক
প্রকাশিত: ১৬ জানুয়ারি ২০১৫, ০৫:৪৫
আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০১৫, ০৫:৪৫

[একুশ শতকে বিশ্বব্যাপী ধর্ম নিয়ে যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও সংঘাত বিস্তৃত হচ্ছে তাতে মানবজাতি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাই জাগছে। প্রতিটি দেশেই ধর্মীয় সহনশীলতা দ্রুত হ্রাস পেয়ে চলেছে। একমাত্র ব্যতিক্রম জাপান। জাপান কীভাবে ধর্মকে দেখছে এবং ধর্ম কীভাবে এই রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নের সহায়হ হিসেবে কাজ করেছে এবং ভবিষ্যতে অভূতপূর্ব ধর্মীয় মতাদর্শের সমন্বয় ও বৈচিত্র্য দেশটিকে ক্রমাগত উজ্জ্বল করে যাবে প্রকৃতিরক্ষা ও বাস্তব্যবিদ্যার আলোকে----সেই সম্পর্কে একটি সারসংক্ষিপ্ত অনুসন্ধানকৃত প্রবন্ধ আগামীকাল থেকে ফেইসবুক বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করার ইচ্ছে। এটা ২০১১ সালে দৈনিক জনকণ্ঠের ঈদসংখ্যাতে প্রকাশিত হয়েছিল। অনেকেই পড়েননি সেটা আমি নিশ্চিত। কিন্তু পড়ে আলোকিত হবেন তাতে কোনো ভুল নেই।] ২০০৮ সালের মে মাসের ৩০ তারিখে প্রকাশিত বিশ্বের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক সংবাদপত্র য়োমিউরিশিম্বুন এর একটি জরিপে কিছু কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য ছিল দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো। প্রতি বছরের মতো এবারও পত্রিকার অনুসন্ধানক্রমে জানা যায় যে, ‘৭২% জাপানি নাগরিক কোনো ধর্মকেই বিশ্বাস করেন না! এই মনোভাবাপন্ন লোকের সংখ্যা আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। কোনো একটি ধর্মে বিশ্বাস করেন ২৬% লোক। ধার্মিকতায় অনুৎসাহী ৪৫%। কিন্তু পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৯৪%-এ উন্নীত হয়েছে। প্রকৃতির মধ্যে মানুষের শক্তির চেয়েও বড় কোনো শক্তি কাজ করে বলে বিশ্বাস করেন ৫৬% লোক। ২০০৫ সালের জরিপে অবিশ্বাসীদের হার ছিল ৭৫%; কোনো একটি ধর্মে বিশ্বাস আছে লোকের সংখ্যা ২৩%। ২০০৮ এর জরিপের সঙ্গে খুব একটা পার্থক্য নেই বলা যায়। কিন্তু আবার ১৯৭৯ এর জরিপে দেখা যায় কোনো একটি ধর্মে বিশ্বাস করেন এমন লোকের হার ৩৪%। ২৯ বছরের ব্যবধানে ১১% হ্রাস পেয়েছে। প্রায় ৩০ বছরের ব্যবধানে শতকরা ৭২ ভাগ মানুষ কোনো ধর্মেই বিশ্বাস করেন না---নিঃসন্দেহে এই সংবাদ পড়ে আমার মতো অনেকেই অবাক হয়েছেন। অবাক হবারই কথা কেননা যেদেশে সর্বত্র ধর্মের জয়জয়কার, মন্দিরের ছড়াছড়ি ---সেদেশের অধিকাংশ মানুষের ধর্মে বিশ্বাস নেই তা কী করে হয়! তবে আধুনিক যুগে সনাতন ধর্মের গুরুত্ব যে আগের মতো নেই এটাও সত্য। দেশে দেশে নতুন নতুন ধর্মগোষ্ঠী গড়ে উঠছে তাদের অধার্মিক, সস্তা জনপ্রিয় কর্মতৎপরতার দিকে নতুন প্রজন্ম ঝুঁকে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পরিণত বয়সে অধিকাংশ মানুষকেই দেখা যায় সনাতন, প্রাচীন পথেই ফিরে আসতে। পাপপুণ্যের বিচার-আচার সম্পর্কে চেতনাবোধ ধীরে ধীরে জন্ম লাভ করতে থাকে যখন বয়সের মাত্রা ৫০ ডিগ্রি পর্যন্ত ওঠার পরপরই অতীত কর্মের ছায়াগুলো দ্রুত নিচের দিকে নামতে থাকে। সনাতন ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে অধিকাংশ বয়স্ক মানুষ। জাপানেও এর ব্যতিক্রম নেই। তবে ধর্ম নিয়ে ব্যবসা, রাজনীতি, অকল্যাণকর বাড়াবাড়ি শত বছর ধরেই জাপানি সংস্কৃতি-বিরুদ্ধ। উক্ত পত্রিকার জরিপ এই সংস্কৃতিরই অনুরণন বলে মনে হয়। ২০০৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর সরকার কর্তৃক প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায় যে, জাপানে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী লোকসংখ্যা যথাক্রমে: শিন্তোও ১০৬,৮১৭,৬৬৯ (৫১.১%); বৌদ্ধ ৮৯,১১৭,৭৬৯ (৪২.৭%); খ্রিস্টান ৩,০৩২,২৩৯ (১.৫%); অন্যান্য ৯,৮১৭,৭৫২ (৪.৭%)। ধর্মে বিশ্বাস বা সচেতনতা না থাকলেও সামাজিক রীতিসমূহ যেমন হাৎসুমোদে বা নববর্ষের প্রথম দিনে মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করা, শুস্সান বা শিশুজন্ম, শিচিগোসান বা শিশুদের ৩, ৫ ও ৭ বছরে পদার্পণ উৎসব, নিউগাকুশিকি বা বিদ্যালয়ে প্রবেশানুষ্ঠান, শিকেন বা পরীক্ষা, সাবালকত্ব প্রাপ্তি বা সেইজিন নো হি (Coming of age day), কেক্কনশিকি বা বিবাহ অনুষ্ঠান, সোওশিকি বা শ্রাদ্ধানুষ্ঠান, সেৎসুবুন নো হি নো মামেমাকি বা বসন্তঋতুর প্রারম্ভ দিবসে বিচি বিতরণ (A bean-scattering ceremony), হিনা মাৎসুরি বা পুতুল উৎসব, ওবোন উৎসব প্রভৃতি যা সচরাচর পরিলক্ষিত হয়---এসবের টানে ৮১% লোক বছরে একবার না একবার জিনজা (Shrine), মন্দির (Pagoda), গীর্জায় (Church) প্রার্থনা করতে যান। এই যে সেদিকে যাওয়া এটাই জাপানিদের সংস্কৃতি। আর এর পেছনে অর্থাৎ জাপানিদের মানসে এই ভূখন্ডের জলবায়ু-ভূমিজাত অতিপ্রাকৃতিক, প্রাচীন আধ্যাত্মিক বিশ্বাস যার আধার হচ্ছে ‘শিন্তোও’ দর্শন---প্রতিনিয়ত সচেতনভাবেই জাপানি সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রিত করছে---ধর্ম সেখানে একটি সাধারণ সামাজিক পরিচিতিমাত্র বলেই প্রতীয়মান হয়। খুব গভীর দৃষ্টি দিয়ে পর্যবেক্ষণ না করলে এই প্রচ্ছন্ন ছবিটি মনোগোচর হয় না। আবার একই পত্রিকার ২০.১১.২০০৯ তারিখে প্রকাশমান ধারাবাহিক ‘চোওজু কাকুমেই’ বা ‘দীর্ঘায়ুর বিপ্লব’ শীর্ষক মূল প্রতিবেদনের ‘মৃত্যুজন্মদর্শন’ পর্বের তৃতীয় অধ্যায়ে দেখি বৃদ্ধ বয়সে মন্দিরের সেবাযত্নে, শান্তিময় পরিবেশে দেহ রাখতে আগ্রহী ৭১% লোক। রিনশোও বুক্কিয়োওজো নামক একটি বৌদ্ধ ধর্মীয় গবেষণাকেন্দ্র ৪০-৬৯ বছর বয়সী ৬০০ লোকের উপর এক জরিপকৃত তথ্যে একথা তুলে ধরেছে। উত্তরদাতারা বলেন যে, ‘মৃত্যুর সময় ধর্মই হোক একমাত্র মানসিক ভরসা।’ ব্যস্ততম জাপান দ্রুত সিলবার সোসাইটি বা বয়স্কসমাজে পরিণত হচ্ছে; জীবনজীবিকায় সন্তানরা এতই ব্যস্ত যে বৃদ্ধ পিতামাতার সেবাযত্ন করার সময় নেই কারোর। এই অবস্থায় বৃদ্ধাবাস বা মন্দির ছাড়া আশ্রয় পাবার উপায় নেই। ধর্মীয় মন্দির হলে পরিবেশও যেমন শান্তস্নিগ্ধ তেমনি সেখানে নিয়মিত অনুষ্ঠিত ধর্মীয় সভা, আলোচনা, সংস্কৃতিচর্চা মানসিক শক্তি অর্জন ও আনন্দের জন্য এক পরম আশীর্বাদ। ক্রমবর্ধমান বয়স্ক সমাজের কথা চিন্তা করে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও মন্দিরগুলো বৃদ্ধদের জন্য সেবাযত্ন ও কল্যাণকর প্রকল্প, পরিকল্পনা বৃদ্ধি করে চলেছে। ২০০৭ সালে কলকাতার একজন স্বনামধন্য তরুণ বৌদ্ধভিক্ষু বুদ্ধপ্রিয় ভান্তে টোকিও এসে অবাক হয়ে বলেছিলেন, “জাপানের মতো এত বৌদ্ধ মন্দির আর কোথাও দেখিনি! সর্বত্রই দেখছি মন্দির!” জাপানের এমন কোনো শহর, গ্রাম, বন্দর, পাহাড়-পর্বত, দ্বীপ নেই যেখানে ছোট-বড় শিন্তোও এবং বৌদ্ধ মন্দির চোখে পড়বে না। বহু জায়গায় এমন দৃশ্য খুব স্বাভাবিকভাবেই চোখে পড়বে পথচলার সময়: জনমনিষ্যির চিহ্ন নেই নির্জন বন, জঙ্গল বা গাছগাছালির ঝোঁপের আড়ালে কাঠের তৈরি ক্ষুদ্র দোচালা, চৌচালাবিশিষ্ট শিন্তোও, বৌদ্ধমন্ডপ বা দেবাসন স্থাপিত আছে, তাতে পাথরের তৈরি ‘ওজিজোওসান’, ‘শিয়ালের মূর্তি’ অধিষ্ঠিত। শেয়াল এদেশের লোকবিশ্বাস অনুযায়ী মাটি, খাদ্য, কৃষি, শস্যদেবতাও বটে। এই দেবতার নাম ‘ইনারি নো কামি’ বা ‘ইনারিশিন্’ প্রভৃতি। সর্বত্রই শিন্তোও মন্দির (জিনজা) বা কোনো কোনো বৌদ্ধমন্দিরের ভিতরে, ফটকের সামনে শেয়ালের প্রস্তর বা কাষ্ঠমূর্তি স্থাপিত আছে। তাছাড়া ‘ইনারি জিনজা’ নামে বহু শিন্তোও মন্দিরও বিদ্যমান। এই দেবতাদের সামনে রাখা থাকে ছোট্ট চীনাপাত্র, ক্ষুদ্র ‘নিহোনশু’ মদের শিশি এবং ধূপকাঠি জ্বালিয়ে রাখার ধূপদানি। এবং কোনো কোনো জায়গায় কিছুই নেই কিন্তু প্রগাঢ় কমলা, সাদা বা কালচে রঙের ‘তোরিই’ বা ‘পবিত্র তোরণ’ শুধু দাঁড়িয়ে আছে। উপরোক্ত বস্তুগুলো আদিধর্ম শিন্তোও এবং পরবর্তীকালে আগত বৌদ্ধ ধর্মের চিহ্নবিশেষ। এমনকি দু’দশক আগেও শহরের রাস্তাঘাট, অলিগলিতে ‘ওজিজোওসান’ বা ‘পাথরের দেবমূর্তি’ খুব চোখে পড়ত। মূর্তিগুলোর মাথা ও গলায় লাল সালু কাপড়ের টুকরো বাঁধা থাকত, পায়ের কাছে ধূপকাঠি, ফুল-জল, মদের শিশি ইত্যাদিও দেখেছি। অর্থাৎ স্থানীয় লোকজন পূজা করত এই কারণে যে, এই দেবতারা প্রতিনিয়ত শহরকে রক্ষা করে চলেছেন। শহর রক্ষা পাচ্ছে বলেই নাগরিকরা বেঁচে থাকতে পারছেন। এখন ওইসব দেবমূর্তি আর তেমন করে চোখেই পড়ে না। নগরায়ণ পুরনোকে হটিয়ে দেবে এটাই নিয়ম, কিন্তু কত আর দেবে? সেই তো ফিরে আসছে শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলো নাগরিক সভ্যতাকে প্রকৃতিমুখী করার প্রবণতায়। কেননা প্রকৃতি হচ্ছে---মানুষ ও ধর্মের চেয়েও বহুগুণে অপরিমেয় শক্তিধর তাই ইকোলজি তথা বাস্তব্যবিদ্যার সঙ্গে ধর্মের যে অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক চিরকালের সেটা এখন মানুষ বুঝতে পারছে। উন্নত দেশে শিশু-কিশোর প্রজন্মকে প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় রীতিমতো বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষে শিক্ষাই দেয়া হচ্ছে এ ক্ষেত্রে জাপান শীর্ষস্থানীয় দেশ। মাতৃস্বরূপ প্রকৃতি থেকেই যে একদিন বিভিন্ন সংস্কৃতি জন্ম নিয়েছে ‘ধর্ম’ও তেমনি একটি পার্থিব সংস্কৃতি অন্ততপক্ষে জাপানের অভিজ্ঞতা তো তাই বলে। এ সমাজে ‘ধর্ম’ বিষয়টিই যে একটি ‘সংস্কৃতি’ তাতো উপরের জরিপ থেকে স্পষ্টতই বোধগম্য। এবং বলতেই হবে যে, এই সংস্কৃতি জাপানের অভাবনীয় জাতীয় উন্নতির ভিত্তি। এটা সব দেশের পক্ষে তৈরি করে নেয়া সম্ভব হয়নি। হবে বলেও মনে হয় না। প্রতিটি ধর্মই এক একটি জাতিগোষ্ঠীর আঞ্চলিক সংস্কৃতির জরায়ু থেকে উদ্ভূত কিন্তু যখনই অন্য কোনো জাতি বা সংস্কৃতির উপর তা চাপানো বা মেশানোর চেষ্টা করা হয়েছে সংঘর্ষ বেঁধেছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই সংঘর্ষ-সংঘাতের আগুন নেভানো যায়নি, তুষের আগুনের মতো স্থানীয়দের মধ্যে বংশানুক্রমিকভাবে জ্বলছে। ভারতীয় উপমহাদেশ তার উত্তম উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা যায়। তাতে করে সমাজের সর্বত্রই চিন্তা, চেতনা, কর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংঘাত বিরাজমান। সংঘাতটিকে আরও জটিল করেছে শিক্ষার অভাব ও কুসংস্কার। শত শত বছরের ব্যাপক পরিবর্তন, বিবর্তনের মধ্যেও ভারতীয় উপমহাদেশে স্বভূমিজ ও বহিরাগত ধর্মগুলোর সহাবস্থান ও পারস্পরিক সংস্কৃতির সুমিলন ঘটেনি। যুগে যুগে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী সাধক, মনীষী, বুদ্ধিজীবী, পুরোহিত, শাসক-প্রশাসক, গবেষক, সমাজসেবী, মানবসেবী ব্যক্তি বহু রচনা লিখে; সভাসমিতি, অনুষ্ঠান, সম্মেলন, আন্দোলন করেও ধর্মীয় শান্তি স্থাপনে ব্যর্থ হয়েছেন। ব্যর্থ হয়েছে মধ্যযুগে মহামতি আকবরের মহান ‘দীন-ই-ইলাহি’ বা ‘ঐশ্বরিক বিশ্বাস’ মতবাদ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাও। ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর রাষ্ট্রব্যবস্থায় তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা (Secularism) বা বহুধর্মসহাবস্থান (Religious pluralism) আইন হিসেবে প্রয়োগ করার ফলে বরং স্থানীয় মানুষের প্রাচীন এবং সহজাত প্রাকৃতিক বিশ্বাস, রীতিনীতি, সংস্কৃতির ধারা ব্যাহতই হয়েছে। আইন দেখিয়ে দিচ্ছে এই লোকটা হিন্দু, এই লোকটা মুসলমান, এই লোকটা খ্রিস্টান, এই লোকটা বৌদ্ধ বা জৈন কিংবা আস্তিক না নাস্তিক ইত্যাদি। আইন করে ধর্মকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, ধর্মীয় সহনশীলতা নির্ভর করে উদারনৈতিক পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষার উপর। সেই শিক্ষা নেই বলেই শিকড় থেকে বিচ্ছেদ বা উন্মূলভীতি কাজ করে স্থানীয় সম্প্রদায়, জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে। কিন্তু জাপানের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম আশ্চর্যজনকভাবে খালি চোখেই পরিলক্ষিত হয়। যদিওবা জাপান যুগ যুগ ধরে নানাবিধ পরিবর্তন-বিবর্তন, গ্রহণ-বর্জনের স্রোতধারায় স্নাত হতে হতে যে একটি অবিশ্বাস্য ধর্মীয় মৈত্রী ও বৈচিত্র্যময়তার স্তরে এসে পৌঁছেছে তা দেখার চেয়ে বরং অনুধাবন করারই বিষয়। জাপানি নমস্য লেখক আকুতাগাওয়া রিয়ুউনোসুকে’র (১৮৯২-১৯২৭) ছোটগল্প ‘কামিগামি নো হোহোয়েমি’ বা ‘দেবদেবীর হাসি’র উদাহরণ দিয়ে বলা যায় যে, জাপানে দিউস/জিউস (Deus / Zeus), কনফুশিয়াস, মেনশিয়াস, জুয়াংজি, কৃষ্ণ, বুদ্ধ, যীশু যাঁরাই এসেছেন জাপানি জাতিকে বদলে দিয়েছেন কিন্তু আদি সংস্কৃতিকে জয় করতে পারেননি। জাপানিরা উদার মনে তাঁদের এবং তাঁদের ধর্ম, মতবাদকে গ্রহণ করে জাপানি করে নিয়েছেন জাতীয় ঐক্য ও রাষ্ট্রীয় সংহতির লক্ষ্যে। কিন্তু মননের গহীন গহীন ভিতরে লালিত হচ্ছে: জাপানিত্ব বা জাপানিজম। এই জাতিসত্তা আবার শিন্তোও মতাদর্শের বিশ্বাস দ্বারা অবিচ্ছেদ্য প্রভাবিত। যে কারণে দেখা যায় জাপানে প্রাচীনকাল থেকেই গড়ে উঠেছে ‘তাতারি শিনকোও’ নামে একটি বিশ্বাস যা শিন্তোওরই একটি অংশবিশেষ। ‘তাতারু>তাতারি’ শব্দের অর্থ মূলত আত্মা-প্রেতাত্মার অভিশাপ বা অকল্যাণ এটা থেকে রক্ষাকল্পে সেসব আত্মার উপাসনা করা। কিয়োতো নগরের বিখ্যাত গিয়োন মাৎসুরি বা গিয়োন উৎসব এই বিশ্বাসের একটি বহিঃপ্রকাশ। প্রাচীনকালে ইয়ায়োই জাতির আগমনে স্থানীয় জোওমোন জাতি তথা জাপানি জাতির পূর্বপুরুষ ক্রমাগত সংঘর্ষে মূল ভূখন্ড থেকে বিতাড়িত হন তাঁদের অতৃপ্ত আত্মা, আবার ইতিহাসখ্যাত একাধিক গৃহযুদ্ধে নিহত ব্যক্তির আত্মার প্রতি প্রায়শ্চিত্ত করার নিমিত্তে সদগতিমূলক পূজা বা উপাসনার রীতিই হচ্ছে তাতারি শিনকোও। যাকে ঠিক পুঁথিগত সংজ্ঞায় ধর্ম বলা যাবে না তবে আত্মার শক্তিকে প্রার্থনাবিশেষ একটি রীতি যা শিন্তোও মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত একটি আধ্যাত্মিক লোকবিশ্বাস। এই বিশ্বাস আজও লালিত হচ্ছে আধুনিক জাপানি সমাজে। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুধাবন যথার্থ বলেই মনে হয়: “জাপানি সভ্যতার সৌধ এক-মহলা---সেই হচ্ছে তার সমস্ত শক্তি এবং দক্ষতার নিকেতন। সেখানকার ভান্ডারে সব-চেয়ে বড়ো জিনিস যা সঞ্চিত হয় যে হচ্ছে কৃতকর্মতা; সেখানকার মন্দিরে সব-চেয়ে বড়ো দেবতা স্বাদেশিক স্বার্থ। জাপান তাই সমস্ত য়ুরোপের মধ্যে সহজেই জর্মনির শক্তি-উপাসক নবীন দার্শনিকের কাছ থেকে মন্ত্র গ্রহণ করতে পেরেছে; নীট্ঝের গ্রন্থ তাদের কাছে সব-চেয়ে সমাদৃত। তাই আজ পর্যন্ত জাপান ভালো করে স্থির করতে পারলে না---কোনো ধর্মে তার প্রয়োজন আছে কিনা, এবং ধর্মটা কী। কিছুদিন এমনও তার সংকল্প ছিল যে, সে খৃস্টানধর্ম গ্রহণ করবে। তখন তার বিশ্বাস ছিল যে, য়ুরোপ যে ধর্মকে আশ্রয় করেছে সেই ধর্ম হয়তো তাকে শক্তি দিয়েছে, অতএব খৃস্টানিকে কামান-বন্দুকের সঙ্গে সঙ্গেই সংগ্রহ করা দরকার হবে। কিন্তু, আধুনিক য়ুরোপে শক্তি-উপাসনার সঙ্গে সঙ্গে কিছুকাল থেকে এই কথাটি ছড়িয়ে পড়েছে যে, খৃস্টানধর্ম স্বভাব-দুর্বলের ধর্ম, তা বীরের ধর্ম নয়। য়ুরোপ বলতে শুরু করেছিল, যে-মানুষ ক্ষীণ তারই স্বার্থ নম্রতা ও ত্যাগধর্ম প্রচার করা। সংসারে যারা পরাজিত সে-ধর্মে তাদেরই সুবিধা; সংসারে যারা জয়শীল সে-ধর্মে তাদের বাধা। এই কথাটা জাপানের মনে সহজেই লেগেছে। এইজন্যে জাপানের রাজশক্তি আজ মানুষের ধর্মবুদ্ধিকে অবজ্ঞা করছে। এই অবজ্ঞা আর কোনো দেশে চলতে পারত না; কিন্তু জাপানে চলতে পারছে তার কারণ জাপানে এই বোধের বিকাশ ছিল না এবং সেই বোধের অভাব নিয়েই জাপান আজ গর্ব বোধ করছে---সে জানছে, পরকালের দাবি থেকে সে মুক্ত, এইজন্যই ইহকালে সে জয়ী হবে। জাপানের কর্তৃপক্ষেরা যে ধর্মকে বিশেষরূপে প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন সে হচ্ছে শিন্তো ধর্ম। তার কারণ, এই ধর্ম কেবলমাত্র সংস্কারমূলক, আধ্যাত্মিকতামূলক নয়। এই ধর্ম রাজাকে এবং পূর্বপুরুষদের দেবতা ব’লে মানে। সুতরাং স্বদেশাসক্তিকে সুতীব্র করে তোলবার উপায়-রূপে এই সংস্কারকে ব্যবহার করা যেতে পারে।” তাই মনে হয় পরিবর্তনশীল সময়ের প্রয়োজনে যে ধর্ম তার অনুসারীদের মনে স্বাদেশিক উন্নয়নের স্বার্থে সংস্কারের ইচ্ছে ও সাহস জাগাতে পারে না সে ধর্মের ধর্মাবলম্বীরা জাপানি মানসকে বোঝা এক কথায় কঠিন। বহু বছর এদেশের জলবায়ুতে বসবাস করলেও জাপানি জাতির ধর্মীয় সংস্কৃতিকে বুঝতে পারেননি এমন বিদেশীর সংখ্যা আদৌ কম নয়। তথাপি জাপানের নিজস্ব এবং বহিরাগত ধর্মের জাপানিকরণ হওয়ার ফলে ধর্মীয় আচার-আচরণে বহুমাত্রিক জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে এটাও সত্য। বস্তুত শিন্তোও ধর্মও খুবই জটিল ও ব্যাপক একটি দর্শন কিন্তু সামাজিক ঐক্যে এই জটিলতার কোনো বিরূপ প্রভাব নেই বলেই প্রতীয়মান হয়। আজকে সেই জটিলতার কোনো প্রসঙ্গ নয়, ব্যাখ্যা বা অনুবাদ নয়, কোনো প্রকার সমালোচনাও নয় বরং জাপানিদের স্বাধীন ধর্মকেন্দ্রিক সৌন্দর্যবোধ ও সংস্কৃতিচর্চা কীভাবে সহাবস্থান, ধর্ম-সহিষ্ণুতা এবং আভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে অভাবনীয় ভূমিকা রেখে এসেছে এবং এখনও রেখে চলেছে যা একান্তই শিক্ষণীয়, অনুকরণীয় সে সম্পর্কে একটি রূপরেখা তুলে ধরার উদ্দেশ্যেই এই প্রবন্ধটি লেখার চেষ্টা। যদি এই লেখা থেকে কিছু আলোর সন্ধান পাওয়া যায় তাহলে এই পরিশ্রম সার্থক হবে বলে মনে করি। [এই বিভাগে প্রকাশিত মতামতের জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নহে]