ছবি সংগৃহীত

গল্প- "বাতাস ভেজানো বৃষ্টি"

Mamun M. Aziz
লেখক
প্রকাশিত: ০২ জুলাই ২০১৩, ১১:০৫
আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৩, ১১:০৫

এক. নাত বউডারে বৃষ্টি পাগলা জিনে ধরছে, বুঝলেন খালা, হে গোর কেউ আবার রোইদ ও ভালা পায়, হেইগুলানরে কয় রোইদ পাগলা জিন। আবার আমগো গ্রামের বাইতে আমগো বাড়ির পাশের এক মাইয়্যারে ধরছিল গাছ পাগলা জিন, হেই মাইয়া হারাদিন গাছে উইঠা বইয়া থাকত। রাহেলার মার সে কথা দাদী খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। তিনি জানেন রাহেলার মার সকল কথাই অতি রঞ্জিত, কিন্তু তা হলে কি হবে তিনি নিজেও বিশ্বাস করেন তার নাত বউয়ের উপর নির্ঘাত কোন জিন ভূত আছর করেছে। না হলে এই উত্তাল যৌবন নিয়ে গেরোস্ত ঘরের নতুন বউ সকাল, দুপুর, সন্ধ্যার বালাই নেই, বৃষ্টি হলেই উঠোনে ভিজেছে, কখনও ছাদের উপর;কখনও বা ছাদে ওঠার গোলাকার প্যাঁচ দেয়া লোহার সিঁড়ির কোন এক ধাপে বসে সে ভিজতেই থাকে। শাশুড়ি, দাদী শাশুড়ি কারও বারণই সে শোনে না। এমনেতে অন্য সময় কত ভদ্র ব্যবহার, অমায়িক মিষ্টি বউ। অথচ বৃষ্টি হলেই সকলকে ভুলে যায়। জিন, জিন... এ যে জিনেরই আছর তা শাশুড়ি আর দাদী শাশুড়ির সাথে পাড়া প্রতিবেশি মহিলা যাদের এ বাড়িতে যাতায়াত আছে সকলেই বিশ্বাস করে নিয়েছে। নিশ্চিতে এ জিন বউ গ্রামের বাড়ি থেকে সাথে করে নিয়ে এসেছিল। কাছাকাছি এক অজ পাড়া গাঁয়ের মেয়ে সোনালী। বিয়ে হয়ে গেলো হুট করে গত চৈত্রে মফস্বলের এই গেরোস্ত বাড়িতে। চালের বিশাল কল আর আড়ৎ তাদের। বাড়ির বড় ছেলে বখতিয়ার মোল্লা, লেখাপড়া তেমন করেনি।ইন্টার পড়তে পড়তে ছেড়ে দিলো।একে বখে যাচ্ছিল, তার উপর দাদা মারা যাবার পর বাবা একা ব্যবসা চালাতে হিমশিম খাচ্ছিল, ব্যবসায় মনোযোগ বসাতে পেরেই তবে পরিবার খুশি হলো- লেখাপড়া দিয়ে কি হবে, ছেলেটা উচ্ছিন্নে তো গেলো না। পুরো ব্যবসা এখন সেই দেখে। ব্যবসা আয়তনে বেড়ছে । এমন ডাকসাইটে ব্যবসায়ী এই মফস্বলের ছোট পরিসরে তার জন্য তেমন সুন্দরী বউতো লাগবেই। আশেপাশের শত গ্রাম চষে তবে এই মেয়ে পাওয় গেলো। সোনা রঙা গা নিয়ে জন্মেছিলো বলেই নাকি মেয়ের নাম রেখেছিল তার মা সোনালী...সেই সোনা রাঙা রূপসী কন্যাটির বিয়েও হলো মফস্বলের সবচেয়ে ধনী গেরোস্তর বাড়িতে, সোনায় মুড়ানো উত্তাল যৌবন নিয়ে চলে গেলো গ্রাম ছেড়ে মফস্বলে। কে না খুশি হয়েছিল? গ্রামে ঢি ঢি পড়ে গিয়েছিল। একবার হলেও উঁকি মেরে কোটি টাকার জামাইয়ের মুখটা দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল সকল গ্রাম বাসী। কেবল সেই ভীড়ের মধ্যে সেদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি একটা মুখ, যে মুখ এই গ্রামের বাতাস, পানি তরু লতার কত চেনা, যে মুখ বারংবার আয়নার মত সামনে এসে নিজেকেই চিনেয়ে দিত সোনালীকে, সেই মুখ সেই যুবকের যে যুবকটি এখন বিভাগীয় শহরে সরকারী কলেজে অনার্স পড়ছে, যার নাম দিয়েছিল সোনালী আপন খেয়ালে সেই শৈশবেই সোনারই আরেক নামে-কনক । সেই হাসি মাখা মুখের সোনালী, যার হাসির খবর মফস্বলের গেরোস্তো বাড়িতেও পৌঁছে গিয়েছিল, সে হাসি আর মুখের লাবন্য দেখে মোল্লা পরিবার একদিনও দেরি করতে পারেনি। দেখতে এল আর সেদিনই কাবিন হয়ে গেলো। উঠিয়ে নিলো এক সপ্তাহ পর। মফস্বলে এসে গেরোস্ত বাড়িতে ক’দিন মেয়েটা বেশ ছিলো। সবার সাথে হাসি মুখের মায়ার জড়িয়ে রাখার অনু পরমাণু চেষ্টাও সে করতে লাগলো। হঠাৎ বৈশাখী ঝড় বৃষ্টি শুরু হতেই থেমে গেলো তার সব হাসি। নিভে গেলো মায়ার প্রদীপ সলতে, চুপষে গেলো প্রাণবন্ত যৌবন উচ্ছলতা তন্বী ষোড়শীর। বাড়ির বহুকালের কাজের বুয়া রাহেলার মার সাথে অন্তত বয়সী নারীকূল সবাই তো বটেই সেই সাথে বখতিয়ারের বাবাও যেন বিশ্বাস করতে শুরু করলো নির্ঘাত বউয়ের ঘাড়ে জিন রয়েছে। দুই. রাহেলার মার সাথে বখতিয়ারের দাদী নাত বউয়ের জিন ধরার আলাপ করতে করতে জানতে চাইলেন, জিন ছাড়ার কোন উপায় আছে নাকি তোমার জানাশোনা? নাই আবার। আমগো গ্রামে জিনে ধরা মাইয়ার সংখ্যা হুনলিতো আপনে টাসকি খাইবেন। তিন গ্রাম পড়েই ওঝা পাড়া। এক এক ওঝা এক এক ধরনের জিন ছাড়ানোর ওস্তাদ। হেগো কাছে গেলে আগে বিস্তারিত হুনাইতে হয়, হুইনা হেরা বোঝে কোন জিনে ধরছে। হেই জিন যে ওঝায় বস করাবার পারে হেরে পাঠায়। হেগোর কছে বোতলে জিন আটকানো থাকে। হেই জিন দিয়া যারে জিনে ধরছে তার জিন ছাড়ায়। বৃষ্টি পাগলা জিনে আমগো গ্রামে কাউরে ধরছে বইলা শুনি নাই। জিনেরা সচারচর বৃষ্টি এড়ায় চলে, নির্ঘাত এইটা ভীষণ বদ জিন, কত্তবড় সাহুস বৃষ্টিতে ছোটে হের চাপ...একবার ওঝা পাড়ায় গিয়া দেখন দরকার কোন ওঝার কাছে বৃষ্টি পাগলা জিন আইটকা আঝে নাকি। থাইকল্যে এক্কেরে সহজ কাম... দাদীর চোখে মুখে খুশির ঝিলিক, বলল-যাও তাইলে একবার গ্রামের বাড়িত গিয়া খোঁজ নিয়া আস না। কাছেই ঘরে খাটে শুয়ে বাড়ির ছোট পোলা ইফতিখার মোল্লা মোবাইলে প্রেমিকার সাথে মধুর বাক্যালাপ করছিলো। সে আধুনিক ছেলে। বিভাগীয় শহরে সরকারী কলেজ সেও পড়ে। আধুনিক সমাজের মোটামুটি সবকিছুতেই সে অভ্যস্ত হতে শিখেছে ফেসবুকে প্রেমিকা জুটিয়ে নিয়েছে। জিনের আছড় আর ঐ সব ওঝা টোঝার কথা শুনে তার মধুর আলাপে ছেদ পড়ায় খুব বিরক্ত হয়ে সে উঠে এসে বলল, রাহেলার মা দাদীরে মুর্খ পাইয়া যা তা বুঝাইতাছ না। খাইয়া দাইয়া কাম নাই। জিন হলো আগুনের তৈরী, বৃষ্টি হেগোর গায়ে পড়লে হেরা নিভা যাইবো গা। ভাবীর হইছে মানসিক রোগ। অবসেসিভ ডিসওর্ডার। কিছুটা হয়তো সিজোফ্রেনিয়াও। এইসব তোমগো বুইঝা কাম নাই। বরং বড় ভাইজানরে বুঝাও, কও ভাবীরে একজন ভালো মনোরোগ ডাক্তার দেখাইতে, দেখবা সব ঠিক হয়ে যাবে । হ তুই দুই পাতা লেখাপড়া শিইখ্যা সব বুইঝা ফেলাইছোস। তোর ভাইজান দেখছোস মনডা কী খারাপ কইরা থাকে। মোল্লা বাড়ির বউ বৃষ্টিতে আর্ধেক উলঙ্গ হইয়া ভেজে, বিদিশা হইয়া ভেজে, মাইনষে তো কইতে কইতে পুরাই উলঙ্গ কইয়ো ফেলায়। কী বিচ্ছিরি, কোন সম্মান থাকলো মোল্লা বাড়ির! কষ্টে বখতিয়ার কাউর লগে কথাও কয় না। কেডা কেডা আমগো পরিবারের বিয় নিয়া মাথা ঘামায়, কও দেখিনি একবার। কল্লা ফেলাই দিমু না। কয় জনার কল্লা ফেলাবি। হকলতেই বলতে শুরু করছেরে ইফতি, পেছনে মা এসে দাঁড়িয়ে আরও যেন উৎকণ্ঠা প্রকাশ করলেন। মার সাথে ইফতি তর্ক করে না কখনই। এখনও করলো না। শুধু বলল, তবে মা আমি শিউর বখতিয়ার ভাইয়ের নিশ্চিয় কোন দোষ আছে এর মধ্যে। তোমরা হয় জান না বা না জানার ভান করতাছ। দাদী ক্ষ্যাপে ওঠে-আমার সোনার টুকরো নাতিডারে ঐ জিনে ধরা খারাপ মাইয়্যা খারাপ কইলেই আমরা মাইনা নিবো নাকি। দাদী, তুমি একটা নারী হইয়া আরেক নারীকে খারাপ বলছ। এটা ঠিক না। তোমাদের কিছু বলতে হবে না। আমিই ভাবীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। বলেই ইফতি হন হন করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো। তিন. সোনালী রান্না ঘরে রাঁধছিলো। বারান্দার সকল কথাই তার কানে পৌঁছায়। কিন্তু কোন ভাবান্তর হয় না। ভাবান্তর সে ছেড়ে দিয়েছে। সে নিয়তির প্রতিটি চাদর গায়ে জড়িয়ে নিয়ে চলতে চেয়েছে। অথচ বৃষ্টি হলেই মাথাটা কাজ করে না। মনের গহীনে জমা এত কষ্ট তখন বিবেক বুদ্ধির সাথে দেহের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ভীষণ জ্বালা ধরে সারা গায়। নিজেকে অস্পৃশ্য, নোংরা মনে হয়। আশেপাশের সবকিছু স্মৃতি থেকে উধাও হয়ে যায়। কেবল বৃষ্টিকে মনে হয় আপন, মনে হয় বৃষ্টির মাঝে লুকিয়ে আছে তার আশৈশব সাথী কমল কুমার দাস যাকে সে নাম দিয়েছিল আদর করে কনক। তখন মনে হয় কেবল কনকই হতে পারে তার নতুন জীবনের পথপ্রদর্শক। মনে পড়ে, মাথায় ঘোরে কেবল কনকের বৃষ্টি ভেজা দিনের এক শেষ কথা। বৃষ্টি থেমে গেলে মাথাটা ঠান্ডা হয়। সব কিছু নতুন করে মেনে নিতে মন চায়, অথচ রাতে পাষন্ড বখতিয়ার কাছে এসে শুলেই নিজের উপর ঘৃণা বেড়ে ওঠে। ঘৃণা বেড়ে ওঠে এই দেহের উপর। যে দেহ নিয়ে কত উপমার আর দুষ্টুমীর চেষ্টা করতে করতে আর স্পর্শ করার সাহস পেতো না কনক। বখতিয়ারের সাথে তেমন কথা হয় না। তার দেহের উপর বখতিয়ারের বিন্দু মাত্র প্রেম আছে বলে তার কখনও ভাবনারও অবকাশের প্রয়োজন পড়ে না। অথচ মাঝে মাঝে লোমশ হাতদুটো এগিয়ে আছে, প্রথম প্রথম বখতিয়ারের অপকর্মের ইতিহাস জানার পর যখন দেহটা ছিঁড়তে আসত--বাধা দিয়ে কয়েকদিন ঠেকাতে পেরেছিলো। এখন আর চেষ্টা করে না, তাতে বরং অত্যাচারের চিহ্ন রয়ে যায় দেহে, বুকের নরম মাংস পিন্ডে কালসিটে দাগ পড়ে যায়, অথচ বিয়ের পর এই দাগই সে প্রেমের নিষ্পাপ চিহ্ণ হিসেবে মেনে নিতে চেয়েছে। গোসলের সময় দাগের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসিও দিতো, ভাবত আদরেরই তো চিহ্ন। অথচ আজ সঁপে দেয় নিঃশ্বাস চেপে রেখে। চিহ্ন নয়, আজ মনে হয় বিষ মাখানো ছুরির আঁচর। বিয়ের ঠিক মাস খানেক পরেই টের পেয়েছিলো স্বামীর দেহে অন্য নারীর স্পর্শের নিদর্শন। একটুও অস্বীকার করেনি বখতিয়ার। অকপটে বলেছিলো, দেখো আমরা এই মফস্বলের সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ী পরিবার। বড় বড় নেতারাও এখানের আমাদের তোয়াজ করে। আমাদের চাঁদায় তাদের নির্বাচন হয়। আমাদের সংসারে তোমার মত সুন্দরী একটা বউ থাকা খুব দরকার। তোমার কাছে রূপ আছে, তুমি আমাগোর সেই দরকার পুরণ কইরা দিছো। তোমার কিছুর অভাব হইছে কও এই ক’দিনে? টাকার আমাগো কমতি নাই। যখন যা মনে চাইবো খাইবা,যা পড়তে মন চাইবা-পড়বা। আমার এক নারীতে হয় না। এই টা আমার সেই স্কুল জীবন থেকে অভ্যাস। তোমার জন্য যতটুকু দেহের সুখ দরকার আমি দিমু। তয় আমি কই গেলাম-এই প্রশ্ন তুমি করতে পারবা না। তুমি গ্রামে কোন হিন্দু পোলার সাথে হাটে মাঠে ঘাটে ঘুইরা বেড়াইতা সেই কথা বিয়ার সময়ই আমার কানে আসছে। তোমার গ্রামের অনেকেই আমার আড়তে ব্যবসার কাজে আসে। গ্রামের ঐ সব চরক কথা গোপন থাকে না। কিন্তু আমার ভয়ে তারা এখন গোপন রাখবো। আমিও অতীত ভাইবা সব মনের থেইক্যা মুইছা দিছি। তুমি আবার সাফাই গাইতে গিয়া বইলো না তোমাগোর মধ্যে কিছু হয় নাই , উঁচু ধান ক্ষেতের মাঝে আইলে বইসা থাকতা, আর হেয় তোমার বুকে হাত দিতো না, এইটা কোন পুরুষ মানুষ বিশ্বাস করবো না। তারপর বৃষ্টির মাঝে নৌকায় করে বিলের জলে ঘুরতা, গাছের তলায় ভিজতা, কয়বার করছ ?...থাক কওন লাগবো না, আমারে ঠিকমতো দিলেই হইবো। নাইলে কিন্তু গ্রামে তোমার বাবা-মা ভাইও অপমান সহ্য করতে পারবো না। সেদিন অমন কথায় ঠিক ভয় না পেলেও নিজের উপর ঘৃনা হচ্ছিল, কনকের উপর ভীষন রাগ হচ্ছিল, রাগ হচ্ছিল এই হারামী বখতিয়ারের উপর, রাগ গুপ্ত এক আক্রোশ হয়ে উঠেছিল যখন স্বামী একটু পরেই দ্রুত দেহের অভ্যন্তরে নষ্ট খেলা করছিল, প্রেমহীন নোংরা খেলা। মনে হচ্ছিল এই হারামীটাই কেবল এই জীবনে কেনো এই সোনালী দেহটা নিয়ে যা ইচ্ছে খেলছে, কেনো সেই এত আপন বন্ধুটি জীবনে একটি বারও হাত দিয়ে দেহটা ছুঁয়ে দেখলো না, কেনো? এ এক ক্ষোভ হয়ে নষ্ট স্বামীর ধর্ষনের সময় নতুন কষ্ট হয়ে উঠেছিল। কতটা নষ্ট পুরুষ হলে প্রতিদিন এসে গল্প করে শোনায় তার নতুন নতুন রমনী আর বেশ্যার সাথে সঙ্গমের কুরুচীপূর্ন বর্ণনা। সে কি শোনা যায়! সে যে বিষের কথা। দেহে বিষ, বাতাসে বিষ, কর্ণে বিষ, ওষ্ট্যে বিষের পরশ, ভেতরে বিষের দৌড়াত্ম্য। কেবলই তখন মনে হয়, বিলের ওপাশে আম বাগানে যেদিন দু’জনে তারা ঢুকেছিল দৌড়ে । প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। ঘন পাতার নিচে যতটুকু বৃষ্টি হতে বাঁচা যায়। একটা গর্তে পা পিছলে পড়েই যাচ্ছিল সোনালী। কনক হাত ধরে হেচকা টান না দিলে ভালোই আহত হত। বেশ বড় গর্ত। কব্জিটা লাল হয়ে উঠেছিল। পাতা হতে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছিলো, সোনালী হাতটা ডলছিল । কনক বলছিল, খুব ব্যথা পেয়েছিস। ওভাবে না ধরলে তো পড়েই যেতি। সোনালী বলল, আমি কি কিছু বলেছি তোকে। তাপর হঠাৎ কনক চোখটা চোখের বরাবর নিয়ে বলেই উঠলো, কিরে বৃষ্টির ফেঁটায় তোর ব্লাউজের দুটো বোতামই খুলে গেলো, আরও খুললেই সেরেছে, আমি তো তখন পুরুষ মানুষ হয়ে উঠব রে। মনে মনে সোনালী বলছিল, তাইতো চাই, হয়ে ওঠ না- বলেই সে ভাঁজ হয়ে ওঠা শাড়ীর আঁচলটা এক পাশে সরিয়ে আরও দুটো বোতাম খেলার দিকে বেহায়ার মত এগোচ্ছিল, হাতটা টেনে ধরে কনক বলেছিল, এইতো ঢেড়, এর চেয়ে বেশি আমি সহ্য করব কেমনে, সূর্যের দিকে কতক্ষণ তাকানো যায় বল তো? অথচ সেই সূর্য নিয়ে রাতে হাডুডু খেলে প্রায়ই বখতিয়ার। সূর্যের আলোতো সেদিনই নিভে গেছে, সেদিনই যেদিনই স্বামীর প্রকৃত রূপ সামনে চলে এসেছিল। ওদিকে যতই স্বামীর বিকৃত রূপ স্মৃতির পাতা হতে মুছে ফেলার জন্য কনকের কথা ভাবে, কেবলই ঐ এক বৃষ্টি ভেজা আমতলা, বিলের ওধারে। আর কিছু নেই। আর সব সে তো কেবলই পুত: পবিত্র। আজ আর পুত: পবিত্র দিয়ে কি হবে। মাঝে মাঝে আপন মনে মন অবশ্য সে হেসে ওঠে। ছোটবেলায় একসাথে স্কুলে যেত দু’জনা। রাস্তাটা বৃষ্টিতে পিছল ছিলো। একটু উঁচু ছিলো এক পাশে। সেখান দিয়ে হাঁটছিল সোনালী। হঠাৎ পিছলে এসে পড়ল সোজা রাস্তায় থাকা কনকের উপর। তারপর দুজনেই গড়াগড়ি। মা খুব বকেছিল। ভেবেছিলেন ইচ্ছে করেই। মা আরও একদিন খুব বকেছিল, যেদিন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল অথচ তখনও বাড়ি ফেরা হয়নি সোনালীর। ক্লাশেরই একটা মেয়ের বিয়েতে গিযেছিল, সাথে সোনালী। মেযেটার খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল। সোনালী তার জন্য সান্তনার বিমূর্ত প্রতীক হয়ে না যেয়ে পারেনি। নদীর ওপারে ছিলো বিয়েটা। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা তো হবেই। আবার গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি সেদিনও শুরু হয়েছিল। কনক সোনলীকে রেখে ফিরে যাচ্ছিল, তখনই কানে এল, সোনালীর মা বকছেন- ও হিন্দুর ছেলে, লোকে কি বলবে, তোদের প্রেম কখনও সত্য হবার নয়, বিয়র বয়স যায় এখনও বুঝছ না। ... তার চার মাস পরেই বিয়ে হয়ে গেলো। সোনালী তখন সবে এসএসসিটা দিয়েছে। আর কনক এইএসসি শেষ করে বড় শহরে গেছে পড়তে। বিয়ের খবর ঠিকই পেয়েছিল কিন্তু এল না একটিবারও। অথচ কয়েকদিন আগে এক সন্ধ্যায় হঠাৎ সোনালীর দেবর এসেছে শহর থেকে ছুটিতে বাড়িতে । তার সাথে একটা হিন্দু ছেলে। বাড়ির বড় বউ শরবত দিতে ঢুকেছিল সবে তারপরই চেহারাটার দিকে তাকিয়েই ঘোমটা টেনেছিল। বুদ্ধিমান ইফতিখার সাথে সাথে বলে উঠেছিল, ভাবী চেন নাকি বন্ধুটিকে? তোমাদের ওদিকে বাড়ি। সোনালী মাথা নেড়ে বলেছিল, না। তারপর ছুটে গিয়ে এক দৌড়ে উঠেছিল বাড়ির ছাদে। একটু পরেই বৃষ্টি নেমেছিল। সে রাতে কনক এ বাড়িতেই ছিলো। সোনালী ছাদ হতে সারা রাত নামেনি। বখতিয়ারের নিকট কনকের এত কাছে সে ধর্ষিত হতে চায়নি। বৃষ্টিতে ভিজেছে আর কেবল মনে করেছে সেই কথাটুকো কনকের- এইতো ঢেড়, এর চেয়ে বেশি আমি সহ্য করব কেমনে, সূর্যের দিকে কতক্ষণ তাকানো যায় বল তো? চার. দুপুরের রান্না শেষে খাটে বসে নিজের অদৃষ্ট নিয়ে ভাবছিলো। গতরাতেই বখতিয়ার জানাচ্ছিল, দেখ সোনালী তোমার বাবাকে গ্রামে আমি একটা নতুন দোকান কিনে দেব বলে ভাবছি। তার পুরাতন দোকানটা আগুনে পোড়ার পর মালিক ছেড়ে দিতে বলেছে জানতো। ওটা গেলে চলবে কেমনে তার? তোমার আরও একটা ছোট বোন আছে । তোমার বাবা আমার কাছে এসেছিল হাত পাততে। আমার শ্বশুর বলে কথা, তার অবস্থা খরাপ হলে লোকে আমাকে কি বলেব?..কিন্তু তোমাকেও কিন্তু একটা কথা শুনতে হবে। বৃষ্টিতে ভেজার এই ভাড়ামি ছাড়তে হবে। না হলে তোমার বাবার দোকান যেমন কেড়ে নিয়েছি, জমি জমাও কেড়ে নিতে আমার সময় লাগবে না। নিশ্চয় বুঝতে পেরেছো। হারামী, তুই শাস্তি আমারে দে, নে এই নে আমার শরীর ছিঁড়ে খুঁড়ে তোর খায়েশ মেটা। আবার বাবা মারে কিছু করিস না। করিস না। আল্লাহও সইবে না। ঠিকাছে। কিন্তু বৃষ্টিতে ভেজার ঐ ঢং... সোনালী চুপ করে ছিল । ...ঘুম ঘূম আসছিল। হঠাৎ বাতাসের ঝাপটায় লাফিয়ে ওঠে। জানালার বাইরে তাকায়, ঘন মেঘে আকাশে। বাতাস ছুটেছে। দু এক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ছে। মন উতলা হচ্ছে। হঠাৎ পেছনে একটা হাতের স্পর্শ পায় । ইফতিখারের হাত। বলে, ভাবী ডাক্তারের সাথে আলাপ করেছি। যাবে একবার কালকে? সোনালী হাসে। ভাবী আমি জানি। কনক আমার ভালো বন্ধু। ওর গ্রামের এক মেয়ের সাথে তার গভীর বন্ধুত্ব ছিলো আমাকে সে আগেই বলেছিল। বলেছিল তার পূজোর নৈবদ্য সেই নারী। সেদিন যেদিন এ বাসায় এল, কারও আসলে বলার দরকার ছিল না, তুমিই সে তা আমি বুঝেছিলাম। আমি জানি ও তোমাকে তার জীবনের চেয়েও ভালবাসে। সাথে ও আমার ভাইয়ের অনেক অপকর্মের কথাও আমর মতই জানে। এ বাড়ীর আর কেউ না জানলেও ভাইয়ার বিষয় আমি জানি। শহরে ভাইয়ার জন্য খারাপ পাড়ায় পাকাপাকি ঘরও বরাদ্দ আছে, সে সব আমারও জানা। আমরা তোমার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছি, আমাকে অন্তত একটা প্রায়শ্চিত্তের সুযোগ দিয়ো। জানো, কনক না তুমি আমার সেই বদ ভাইয়ের বউ এটা জানার পর থেকে আগের মত হাসে না, সে এখন ... কি হয়েছে, কি হয়েছে কনকের?... কিছু হয়নি। আগে তুমি ডাক্তারের কাছে চল। তারপর তোমাদের দুজনের ব্যবস্থা আমি করে দেব। হাসালে। ডাক্তার দরকার নেই। তোমার ভাইজান ওঝা হয়ে আমার জিন নামিয়ে দিছে। তুমি আমাকে বল প্লিজ বল কনকের কি হয়েছে? কিছু না ভাবি, সে হাসে না ঠিকই, তবে সে আমাদের ফার্স্ট ইয়ার ফাইনালে প্রথম হয়েছে কিন্তু। সত্যি। সত্যি... ইফতি একটা কাজ করে দেবে - কি কাজ? বল আমার কসম, বল করে দেবে? বল না কি কাজ? তুমি শুধু ওকে বলবে তোমার ভাইয়ের নারীর দোষ ভাল হয়ে গেছে। সে এখন কেবল আমাকেই ভালবাসে, কেবল আমাকেই। ও আমি পারবো না ভাবী। তুমি কথা দিয়েছো। কথা তো দেই নি ভাবী, বরং নিজের মনকে নিজে কথা দিয়েছি তোমাদের দু’জনের মিলন আমি ঘটিয়েই ছাড়ব, তার জন্য নিজের ওমন কুলাংগার ভাইকে ত্যাগ করতে হলেও আমি প্রস্তুত। সোনালী ইফতিখারের মুখের উপর কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো, তার চোখ দিয়ে তখন অঝোরে জল পড়ছে আর জানালার বাইরে ঝরছে প্রবল আক্রোশে বাতাস ভেজানো বৃষ্টি। মুখ ঘুরিয়ে বৃষ্টির দিকে তাকায় পরক্ষণেই তারপর আপনাতেই তার চোখের পাপড়ি বন্ধ হয়ে যায়, বন্ধ চোখে সে হাতড়ে বেড়ায় মনের ভেজা বদ্ধ বাতাস।