ছবি সংগৃহীত

আরাকান আর্মি সমাচার

গোলাম মোর্তোজা
লেখক
প্রকাশিত: ৩১ আগস্ট ২০১৫, ০৯:৫৯
আপডেট: ৩১ আগস্ট ২০১৫, ০৯:৫৯

ছবি : আরাকান আর্মির ক্যালেন্ডার থেকে সংগৃহীত বাংলাদেশ খুব ছোট্ট একটি দেশ। দেশের তিনটি জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান। এই তিনটি জেলায় যা ঘটে, তা ঢাকা পর্যন্ত ঠিকমতো এসে পৌঁছায় না। এই ধারা নতুন নয়। ১৯৬০ সাল কাপ্তাই বাঁধ দিয়ে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল, তখনও নগরের মানুষের কাছে সে খবর এসে পৌঁছায়নি। যখন যেভাবে পৌঁছেছে, তাতে ভয়াবহতার মাত্রা বোঝা যায়নি। দেশ স্বাধীন হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। উল্টো যুদ্ধ শুরু হয়েছে। সত্যিকার অর্থে একটা পরিবর্তনের প্রত্যাশা করা হয়েছিল ১৯৯৭ সালে চুক্তির পর। যুদ্ধ বন্ধ হয়েছে। চুক্তির বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড়িদের ভাগ্যের তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। নতুন নতুন অনেক সমস্যা তৈরি হয়েছে। চুক্তির আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়েছি বেড়াতে। সংবাদকর্মী হিসেবে গিয়েছি চুক্তির পরে। রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি-বান্দরবানের আনাচে-কানাচে ঘুরেছি, একনাগাড়ে দীর্ঘদিন অবস্থান করেছি। অঞ্চলটি সম্পর্কে মোটামুটি একটি স্বচ্ছ ধারণা আছে। যখন এই অঞ্চলের কোনো একটি জায়গায় একটি ঘটনা ঘটে, বুঝতে পারি ঠিক কোন জায়গাটিতে ঘটছে। কেন ঘটছে, কি কারণে ঘটছে, কারা ঘটাচ্ছে, বোঝা বা জানা খুব কঠিন হয় না। এবারের আলোচনার বিষয় বান্দরবান। একটি বিজিবি ক্যাম্প আক্রমণকে কেন্দ্র করে আলোচনায় এসেছে ‘আরাকান আর্মি’। প্রথমাবস্থায় শুনলে মনে হয় ‘আরাকান আর্মি’ হয়ত মায়ানমারের সেনাবাহিনী। ঢাকায় বসে আমরা আরাকান আর্মির নামের সঙ্গে পরিচিত না হলেও, বান্দরবান অঞ্চলের সব মানুষই এই নামের সঙ্গে পরিচিত। আমরা এখন জানছি। আরাকান আর্মি মায়ানমারের সেনাবাহিনী বা সরকারি কোনো বাহিনী নয়। দ্য আরাকান আর্মির পরিচিতি ‘এএ’ নামে। আমরা তাদেরকে বলছি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন। অনেকে বলেন মায়ানমারের বিদ্রোহী সংগঠন। তারা নিজেদেরকে বলেন, স্বাধীনতাকামী সংগঠন। চীনের উত্তর-পূর্ব এবং মায়ানমারের একেবারে উত্তরে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে ‘কাচিন’ রাজ্যের স্বাধীনতার জন্যে তারা যুদ্ধ করছে। নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে তারা মায়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। বেশ কয়েক বছর আগে, ‘আরাকান আর্মি’র রাজনৈতিক শাখার একজনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। তার কাছে প্রশ্ন করেছিলাম, আপনারা জঙ্গলে থেকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করছেন কেন? কেন মাদক চাষ, চাঁদাবাজি করেন? মুখে হাসি নিয়ে চোয়াল শক্ত করে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলেছিলেন, ‘আপনারা জানেন না মায়ানমার সেনাবাহিনী প্রতিদিন আমাদের হত্যা করছে। শিশু-বৃদ্ধ কেউ তাদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। নির্যাতিত হচ্ছে আমাদের নারীরা। এর আগে অনেক সংগঠন প্রতিবাদ-আন্দোলন করেছে, সশস্ত্র আন্দোলন করেছে। তারা জঙ্গলে থেকে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি-অপহরণ করেছে বলে মানুষের ভালোবাসা পায়নি। আমরা তার থেকে শিক্ষা নিয়েছি। কাজ করছি অনেক বছর ধরে। আনুষ্ঠানিকভাবে আরাকান আর্মির জন্ম হয়েছে ২০০৯ সালের ১০ এপ্রিল। একটু খোঁজ নিয়ে দেখেন, আমাদের গেরিলা যোদ্ধারা যেসব অঞ্চলে অবস্থান করে, সেসব অঞ্চলে চাঁদাবাজি নেই, মাদক চাষ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আগে যেসব বনের গাছ কেটে ‘পপি’ চাষ করা হতো, আমরা তা বন্ধ করে দিয়েছি। শুধু গাছ এবং বাঁশ চোরাচালানিদের থেকে আমরা একটা ‘রয়্যালিটি’ নেই। স্থানীয় বাসিন্দারা আমাদের দ্বারা কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। খোঁজ নিয়ে দেখেন তারা আমাদের পছন্দ করেন। যাবেন আমাদের সঙ্গে, নিজের চোখে দেখে আসবেন?’ কীভাবে যেতে হবে? ‘এখান থেকে ইঞ্জিন নৌকায় যেতে লাগবে দশ-বারো ঘণ্টা। রাতে সেখানে থাকব। হরিণ অথবা সজারু মেরে খাওয়াব। বুনো শূকর খেতে চাইলে তাও ব্যবস্থা করা যাবে। তারপর হাঁটতে হবে চারদিন। আর একটু বেশি লাগবে, আপনি তো টানা এত হাঁটতে পারবেন না। দেখবেন জঙ্গল-বন-পাহাড় কাকে বলে। দিনের বেলায়ও কোথাও কোথাও এত অন্ধকার যে টর্চলাইট নিয়ে চলতে হয়। আবার কিন্তু এভাবেই ফিরতে হবে। তবে কোনো ভয় নেই, আমাদের লোকজন সঙ্গে থাকবে।’ যাব কিনা, বারবার জানতে চায়। কিছু বলি না, হাসি। নাম একটা জানি, ছদ্মনাম। কোনো ঠিকানা, ফোন নাম্বার নেই। তবুও বলি অন্য সময় যাব, আবার দেখা হবে। দেখা যে হবে না, তা তো জানি। গত কয়েক বছরে ভুলেই গিয়েছিলাম তার কথা, আরাকান আর্মির কথা। বিজিবি ক্যাম্প আক্রান্ত হওয়ার পর আবার আলোচনায় এসেছে আরাকান আর্মি। মনে পড়ল সেই ছদ্মনামের মানুষটির কথা।

২.

বান্দরবানের যে অঞ্চলটিতে তাদের বিচরণ, সেটা বড় বড় পাহাড় এবং গহীন জঙ্গল। বিশাল এই এলাকা ‘সাঙ্গু রিজার্ভ’ নামে পরিচিত। সাঙ্গু রিজার্ভের পূর্বে ভারতের মিজোরাম, দক্ষিণে মায়ানমার। আরাকান আর্মির বিচরণ সাঙ্গু রিজার্ভের যে অংশে সেই জায়গাটির নাম ‘লাতাইন’। এতটাই জঙ্গল যে দিনের বেলাতেও কিছু এলাকা অন্ধকার থাকে। দেখা না থাকলে ঢাকায় বসে ধারণা করা বেশ কঠিন। এই অঞ্চলের সবচেয়ে কাছে বড় মোদকে যে বিজিবি ক্যাম্প আছে, তার থেকে আরাকান আর্মির বিচরণ ক্ষেত্র প্রায় ২০-৩০ কিলোমিটার দূরে। এই দূরত্ব আরও বেশিও হতে পারে। এসব দূরত্ব স্থানীয়দের অনুমানভিত্তিক। কোনো রাস্তা নেই, পাহাড়-জঙ্গল পেরিয়ে যাওয়াটা শুধু ভয়ঙ্কর কষ্টের নয়, আতঙ্কেরও। লাতাইন মায়ানমার সীমান্ত থেকে চার-পাঁচ দিনের দূরত্ব। ভারত সীমান্তের মিজোরাম থেকে কিছুটা কাছে। বান্দরবান থেকে সাঙ্গু রিজার্ভ অঞ্চলে যাতায়াত ব্যবস্থা কিছুটা দূর পর্যন্ত আছে। তারপরের যে যোগাযোগ ব্যবস্থা, তার বর্ণনা শুনলেও ভয় ধরে যায়। বান্দরবান থেকে থানচি পর্যন্ত পাকা রাস্তা। চাঁদের গাড়ি বা বাসে চলে যাওয়া যায় সহজেই। থানচি সদর থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় বড় মোদক পর্যন্ত যেতে দিন পার হয়ে যায়। বড় মোদক পর্যন্ত দেখার সুযোগ হয়েছে। বড় মোদকের আশেপাশে ছোট মোদক, মোদকের আগা, তিন্দু, রেমাক্রি প্রভৃতি ইউনিয়ন, গ্রামগুলো সম্পর্কেও ধারণা আছে। এসব এলাকার ছোট ছোট দোকানে, বাজারে, বড় বড় গাছে আরাকান আর্মির রঙিন পোস্টার চোখে পড়ে। প্রায় প্রতিটি দোকানে পোস্টার লাগানো দেখা যায়। কখনো কখনো বিজিবি টহলে এসে পোস্টার তুলে দিয়ে যায়। আরাকান আর্মি এসে আবার পোস্টার লাগিয়ে দিয়ে যায়। প্রতিবার পোস্টারের বিনিময়ে ১০০/২০০ টাকা দিতে হয় আরাকান আর্মিকে। বড় মোদকের পর থেকেই মূলত ঘন-বড় বন-পাহাড়-জঙ্গল। পায়ে হাঁটা একমাত্র পথ। হাঁটা শুরু করলে চার পাঁচ দিন পরে গিয়ে সাঙ্গু রিজার্ভ এলাকায় পৌঁছানো যায়। এই অঞ্চল দিয়েই সাঙ্গু নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এত দুর্গম এলাকায় মায়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের ১৪৮ কিলোমিটার সীমান্ত। যার প্রায় পুরোটাই অরক্ষিত। এই অরক্ষিত বন-পাহাড় অঞ্চলই আরাকান আর্মির বিচরণ ক্ষেত্র। এই অঞ্চলে ভারতের সঙ্গে ২২১ কিলোমিটার সীমান্তও অরক্ষিত। আরাকান আর্মির সঙ্গে বিজিবির সংঘর্ষের তেমন কোনো সংবাদ জানা যায় না। সাম্প্রতিক সংঘর্ষ ঠিক কি কারণে ঘটল? এখন পর্যন্ত যে তথ্য জানা যাচ্ছে, আরাকান আর্মি তাদের অস্ত্র এবং মালামাল পরিবহনের জন্যে ভারত থেকে ১০টি ঘোড়া নিয়ে আসছিল। ভারত সীমান্ত পার হয়ে থানচি সদর থেকে নৌকায় ঘোড়াগুলো বড় মোদক হয়ে লাতাইন নিয়ে যাচ্ছিল। বিজিবি বলেছে থানচি ক্যাম্পের কাছে ঘোড়াগুলো আটক করা হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য থানচি সদর থেকে তারা ছয়টি ঘোড়া নৌকায় তুলে বড় মোদকের দিকে নিয়ে যেতে দেখেছেন। থানচি সদর থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় বড় মোদক পর্যন্ত যেতে সারাদিন লেগে যায়। স্থানীয়দের বক্তব্য অনুযায়ী ৬টি ঘোড়া আটক করা হয়েছে বড় মোদকে, ৪টি আটক করা হয়েছে থানচিতে। বড় মোদকে আটক ঘোড়ার দু’টিকে পা বেঁধে নৌকায় করে থানচিতে আনার সময় নৌকা ডুবে যায় এবং ঘোড়া দু’টি মারা যায়। বাকি ৪টি ঘোড়া থানচিতে আনা হয়েছে কিনা নিশ্চিত তথ্য জানা যায়নি। এই ঘোড়া আটকের পর আরাকান আর্মির এক-দেড়শ সদস্যের কয়েকটি দল বড় মোদক ক্যাম্প ঘিরে গুলিবর্ষণ শুরু করে। যদিও বিজিবি বলেছে, টহল দলের ওপর আক্রমণ করেছে। স্থানীয়দের ভাষ্য ক্যাম্প আক্রমণ করেছে হতাহতের উদ্দেশ্যে নয়, ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে। বিজিবি গুলিবর্ষণ করে জবাব দিয়েছে। আরাকান আর্মির দলগুলো আবার লাতাইন অঞ্চলের দিকে চলে গেছে। এরপর বিজিবি শক্তি বৃদ্ধি করেছে। হেলিকপ্টারে করে তাদের বড় মোদকে নেয়া হয়েছে। আলিকদম ক্যান্টনমেন্ট থেকে সেনাবাহিনীকেও হেলিকপ্টারে বড় মোদকে নেয়া হয়েছে। বড় মোদকের আশেপাশে ছোটখাটো কিছু অভিযান চালিয়েছে বিজিবি-সেনাবাহিনী। আরাকান আর্মি তার আগেই এই এলাকা ছেড়ে লাতাইন জঙ্গলের দিকে চলে গেছে। বিভিন্ন সূত্রের খবর অনুযায়ী, আরাকান আর্মির সদস্য সংখ্যা ৫ শতাধিক এবং তাদের সংগ্রহে ভারী-আধুনিক অস্ত্র আছে। তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইট এবং ফেসবুক পেজ আছে। আরাকান আর্মির কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল তাওয়ান মার্ট নায়াং এবং সেকেন্ড ইন কমান্ড কর্নেল ড. নিও তাওয়ান অং। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সংগঠন আরাকান আর্মি। ধারণা করা হয়, তাদের হেডকোয়ার্টার থাইল্যান্ডের ভেতরের কোনো পাহাড়-জঙ্গলে। নিয়মিত সেনাবাহিনীর মতোই তাদের প্রশিক্ষণ-অস্ত্র। army আরাকান আর্মি ভারতের ভেতরেও তাদের অবস্থান রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তারা প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রের যোগান পায় থাইল্যান্ড থেকে। চীনের সমর্থন-অর্থ-অস্ত্রও তারা পেয়ে থাকে। থাইল্যান্ড থেকে যাওয়া-আসা, অস্ত্র আনায় এক সময় সমুদ্র পথ ব্যবহার করত আরাকান আর্মি। ইদানিং এই পথ ব্যবহার হয় না বা কম ব্যবহার হয়। এখন অস্ত্রের যোগান আসে ভারতের ভেতর দিয়ে। ভারতের কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় দেয় মায়ানমার। ভারত আশ্রয় দেয় আরাকান আর্মির। প্রশিক্ষণ-অস্ত্র-অর্থ সবদিক দিয়েই শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে আরাকান আর্মি। বান্দরবান অঞ্চলে বিচরণ আরাকান আর্মির এক অংশের। তারা মায়ানমার সীমান্তে কখনও কখনও ভেতরে ঢুকে আক্রমণ করে। দু’একজন মায়ানমার বর্ডার গার্ড বা সেনা সদস্যদের মাঝেমধ্যে অপহরণ করে নিয়ে আসে। কয়েক দিন আগে মায়ানমারের দুইজন সেনা সদস্যকে জঙ্গলে পেয়েছিল বিজিবি। কিভাবে বিজিবি তাদের পেয়েছিল, এলাকায় ভিন্ন গল্প আছে। আরাকান আর্মি তাদের ২০১৫ সালের তিন পাতার ক্যালেন্ডারে বিমান বিধ্বংসী কামানের ছবি প্রকাশ করেছে। বিমান বিধ্বংসী কামান তাদের সংগ্রহে আছে বলে দাবি করেছে। বিজিবি-সেনাবাহিনী সম্মিলিতভাবে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে অভিযান চালাবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।

৩.

আরাকান আর্মির আয়ের উৎস খুবই রহস্যজনক। আগে এই এলাকায় পপি চাষ হতো, এখন হয় না। সেইভাবে চাঁদাবাজিও তারা করে না বলে স্থানীয়রা জানায়। আরাকান আর্মির হাতে অনেক অর্থ, স্থানীয়রাও তাদের দ্বারা উপকৃত হয়। আমেরিকা সাহায্য দেয়-বিষয়ক গল্প প্রচলিত আছে এলাকায়। আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ করতে হবে। সেই যুদ্ধটি করতে হবে গহীন পাহাড়-জঙ্গলে স্থলপথে। আকাশপথে হেলিকপ্টারে বড় মোদক পর্যন্ত যাওয়া যাবে। কিন্তু লাতাইন অঞ্চলের গভীর জঙ্গলে হেলিকপ্টার থেকে কোনো সুবিধা পাওয়া যাবে না। তাদের কাছে বিমান বিধ্বংসী কামান থাকায় বিপদ বাড়তে পারে। সুতরাং স্থলপথে সর্বশক্তি এবং ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি নিয়েই আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে হবে। এই অভিযানে আরাকান আর্মিকে পরাজিত করার শক্তি-কৌশল নিশ্চয়ই আমাদের বিজিবি-সেনাবাহিনীর জানা আছে, সামর্থ্যও আছে। অভিযানের সর্বশেষ যে সংবাদ জানা গেছে তাতে, তিন পার্বত্য জেলার শহরাঞ্চলের আরাকান আর্মির সদস্য বা সহযোগী সন্দেহে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দুর্গম এই সাঙ্গু রিজার্ভ এলাকায় এখন পর্যন্ত অভিযানের কোনো সংবাদ জানা যায়নি। বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেছেন, ‘আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অভিযান যতদিন প্রয়োজন ততদিন চলতে থাকবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে কোনো দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের স্থায়ী ঘাঁটি নেই। তবে দুর্গম এই অঞ্চলে কেউ যে কখনো আসে না বা বিচরণ করে না, তা বলা যাবে না। আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেই।’ এই দুর্গম অঞ্চলে বিজিবি অভিযান কোন প্রক্রিয়ায় কীভাবে চালাবে, তা নিশ্চিত করে জানা যায়নি। বড় মোদক এলাকায় হেলিকপ্টারে করে দেড় থেকে দু’শ বিজিবি-সেনা সদস্য নেয়া হয়েছে। সাঙ্গু রিজার্ভ এলাকায় হেলিকপ্টারে যেহেতু কোনো সুবিধা পাওয়া যায় না, তাই যুদ্ধবিমান উড়তে দেখা গেছে। ধারণা করা হয়, বিজিবির ক্যাম্প আক্রান্ত হওয়ার পর আরাকান আর্মিকে মেসেজ দিতেই বাংলাদেশ যুদ্ধবিমান উড়িয়েছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘আরাকান আর্মি দমনে অভিযান চলবে।’

৪.

বিজিবি ক্যাম্প আক্রমণের পরপরই আরাকান আর্মির সেকেন্ড ইন কমান্ড ড. নিও তাওয়ান অং অনলাইনে জানিয়েছেন, ‘বড় মোদক এলাকার বিজিবি ক্যাম্পে প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে সংঘর্ষ হয়েছে। দু’পক্ষই গুলিবিনিময় করেছে। আশা করছি আমরা আলোচনার মধ্য দিয়ে ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটাতে পারব। আমরা ইতোমধ্যে ব্যাখ্যা করেছি যে, আরাকান আর্মি বাংলাদেশের শত্রু নয়। সব আদিবাসী গ্রুপ বার্মার শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, নিজেদের আত্মমর্যাদা রক্ষা, গণতন্ত্র এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ সরকারের উচিত আমাদের সমর্থন করা। আমরা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি চিঠি পাঠানোর চেষ্টা করছি, সেখানে আমরা এই সংঘর্ষের জন্যে দুঃখ প্রকাশ করব। ভবিষ্যতে যাতে আর কখনো এমন পরিস্থিতি তৈরি না হয়, সে ব্যাপারে সচেতন থাকব।’ বড় মোদকসহ আশেপাশের স্থানীয় বাসিন্দারা গত কয়েকদিন ধরে আতঙ্কে ছিলেন। থানচির একজন হেডম্যান গত কয়েকদিন এই বিস্তীর্ণ এলাকা নৌকায়, পায়ে হেঁটে ঘুরেছেন। তিনি বলছেন, ‘এখন পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এসেছে। স্থানীয়দের মনের আতঙ্কও কেটে গেছে।’

৫.

স্থায়ীভাবে আরাকান আর্মি বা বিচ্ছিন্নতাবাদী নানা গ্রুপের তৎপরতা মুক্ত থাকার জন্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করে পাহাড়িদের আস্থা অর্জন করা দরকার। চুক্তির বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড়িদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। ক্রমশ যা তীব্র হচ্ছে। চুক্তিবিরোধী একটি সশস্ত্র গ্রুপও তৈরি হয়েছে। তাদের মোকাবিলার জন্যে চুক্তির পক্ষের সশস্ত্র গ্রুপের অস্তিত্বও লক্ষ্য করা যায়। মায়ানমারের বেশ কিছু ছোট ছোট সন্ত্রাসী গ্রুপও এই অঞ্চলে বিচরণ করে। আছে রোহিঙ্গাদের তৎপরতা। আশঙ্কার কথা আরাকান আর্মির মতো শক্তিশালী গ্রুপের সঙ্গে যদি পাহাড়িদের কোনো গ্রুপের সম্পৃক্ততা তৈরি হয়ে যায়, তবে আমাদের জন্যে তা নতুন করে বিপদের কারণ হতে পারে। দূরদৃষ্টি দিয়ে বিষয়গুলো দেখা দরকার। সীমান্ত এলাকায় রাস্তার উন্নয়ন করা জরুরি। মায়ানমার-ভারত তাদের সীমান্তে রাস্তা তৈরি করেছে। সাঁজোয়া গাড়ি নিয়ে তারা সীমান্ত পাহারা দেয়। বাংলাদেশ অংশে পাকা রাস্তা তো দূরের কথা, কাঁচা রাস্তারও কোনো অস্তিত্ব নেই। বিজিবি ক্যাম্প থেকে একটি সীমান্ত পিলারে হেঁটে যেতে দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগে। এক পিলার থেকে আরেক পিলারের দূরত্ব চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার। ক্যাম্প থেকে বিজিবি সদস্যরা একটি পিলারে গিয়ে বিপদে পড়লে, তাদের কাছে সাহায্য পৌঁছাতেও কমপক্ষে দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগে। রাতে চলাচল করা যায় না, দিনের জন্যে অপেক্ষা করতে হয়। আবহাওয়া খারাপ হলে দিনে চলাচল করাও কষ্টকর। পার্বত্য চট্টগ্রামের ছয়টি ক্যান্টনমেন্ট আছে। সেনা বা বিজিবি ক্যাম্পের সংখ্যা কমিয়ে সীমান্ত এলাকায় পৌঁছানো এবং টহল দেয়ার রাস্তা তৈরি করা জরুরি। তাহলে চুক্তির শর্তও রক্ষা হয়, সীমান্তও নিরাপদ থাকে। সীমান্ত পার হয়ে আসা-যাওয়া ঠেকানো গেলে, নিরাপত্তা অনেকটা নিশ্চিত হয়। বি. দ্র. : কিছু লিখেছি, কিছু লিখিনি। এই লেখা থেকে কিছু প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে, কিছু প্রশ্ন তৈরি হবে। যেভাবে লিখলে বাস্তবতা বোঝানো আরও সহজ হতো, সেভাবে লিখিনি। কেন লিখিনি, তা লিখছি না। সবাই না হলেও কেউ কেউ নিশ্চয়ই তা বুঝে নেবেন। শুধু একটি কথা বলি, আরাকান আর্মি শক্তিশালী হচ্ছে, বাংলাদেশের ভেতরে বিচরণ করে বাংলাদেশকে আক্রমণ করছে! কি করে এত সাহস হয়? আমাদের নীতি কৌশল নিয়ে নীতি-নির্ধারকদের ভাবা দরকার। লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক