
ছবি সংগৃহীত
অবশেষে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল হচ্ছে
আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০১৬, ০৮:৪৫
(প্রিয় টেক) বহুল আলোচিত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল হতে যাচ্ছে। শুধু ৫৭ ধারাই নয় ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন-২০১৬ (ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন) পাস হলে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৪, ৫৫ ও ৫৬ ধারা বাদ দেওয়া হবে। আজ রোববার আইন মন্ত্রণালয়ে আইনমন্ত্রীর সভাপতিত্বে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) মন্ত্রণালয়ের আইনটির খসড়া নিয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। বৈঠকে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, আইন সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হকসহ আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, আইসিটি অ্যাক্ট-এর ৫৭ ধারা নিয়ে যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল তা দূর করার জন্য ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট-২০১৬ (ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন) প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো স্পষ্ট করা হবে। এ কারণে ৫৭ ধারা নিয়ে যে শঙ্কা তা আর থাকবে না। এই আইনে ডিজিটাল মাধ্যমে করা অপরাধের ধরন বিবেচনা নিয়ে সর্বোচ্চ সাজা ১৪ বছর রাখা হয়েছে। তবে সর্বনিম্ন শাস্তি নির্ধারণ করা হয়নি জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী তা নির্ধারণ হবে।
আইনমন্ত্রী বলেন, আইসিটি আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ধারা নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা ধরনের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা রয়েছে। প্রস্তাবিত এই আইনে সেই উদ্বেগ-উৎকন্ঠা দূর করার চেষ্টা করা হবে। অপরাধ ও শাস্তির বিষয়টি আরো স্পষ্ট করা হবে। প্রস্তাবিত আইনটি জামিনযোগ্য হবে কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, এই মুহূর্তে এটি বলা সম্ভব নয়, তবে এটুকু বলতে পারি শেখ হাসিনার শাসনামলে সাংবাদিকদের জন্য ক্ষতিকর বা উদ্বেগ জাগার মতো কোনো আইন পাস করা হবে না। নিরাপরাধ কোনো লোক হয়রানির শিকার হবে না।
তিনি জানান, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো স্পষ্ট করা হবে। এ কারণে ৫৭ ধারা নিয়ে যে শঙ্কা তা আর থাকবে না। এ আইনের ৪৩টি ধারা আমরা যাচাই-বাছাই করেছি। কিছু কিছু জায়গা ছাড়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় যে খসড়া প্রস্তুত করেছে, আমরা সম্মতি দিয়েছি যে, সেভাবেই তারা ভেটিংয়ে পাঠাবে। কিছু কিছু জায়গা সংশোধন করা হবে। কিছুদিন আগেও এ তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে আলোচনা ছিল, সমালোচনা, আপত্তি ছিল। আমার মনে হয়, সেসব আলোচনা, দুশ্চিন্তা, শঙ্কা দূর হবে।
তিনি বলেন, আইসিটি সেক্টরকে যেহেতু আমরা গুরুত্ব দিয়েছি, সেহেতু কিছু কমিটিতে প্রধানমন্ত্রী নেতৃত্ব দেবেন। যে কারণে গুরুত্ব দিচ্ছি- বিশ্ব পরিস্থিতি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে সাইবার ক্রাইমই সবচেয়ে বড় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। নতুন আইনে ৫৭ ধারার অভিযোগ জামিনযোগ্য হবে কি-না জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, যখন খসড়াটি চূড়ান্ত হবে, তখন জানাতে পারবো।
‘আমাদের পেনাল কোর্ডে যেসব অপরাধ হয়, ডিজিটাল মাধ্যমেও সেসব ধরনের অপরাধ করা যায়। সাইবার ক্রাইম হত্যা ও ধর্ষণের চেয়েও মারাত্মক। সেটাকে অপরাধ বিবেচনা করে তার শাস্তির ব্যবস্থা এ আইনে রয়েছে’- যোগ করেন মন্ত্রী। আমরা যেটা চেষ্টা করেছি, সেটা হচ্ছে- বিদ্যমান আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এ আইনটি করা যায়। আমার মনে হয়, আরেকবারও আলাপ-আলোচনা করতে হবে। তার কারণ হচ্ছে, যেখানে যেখানে পরিবর্তনের কথা বলেছি, সেগুলো আবার দেখা হবে। চূড়ান্তভাবে আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ বিভাগে দেখা হবে।
এ আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছর রাখা হয়েছে। অপরাধ বিবেচনায় সর্বনিম্ন সাজাও রাখা হয়েছে। তবে সর্বনিম্ন সাজা কতো রাখা হয়েছে তা নির্ধারিত হয়নি বলে জানান মন্ত্রী। আইনমন্ত্রী বলেন, সাংবাদিকদের ওপর অবিচার হবে, এমন আইন পাস করা হবে না। আপনারা নিশ্চিত থাকতে পারেন, শেখ হাসিনার সরকারের সময় তা হবে না। আপনাদের দৃষ্টি বিবেচনায় নিয়ে এ আইনের মধ্যে যা করার করা হবে। ৫৭ ধারা নিয়ে যে সংশয় ছিল তা আর থাকবে না। বিদ্যমান আইনের সঙ্গে যেনো কোনো সংঘর্ষ না থাকে তাও সর্বশেষ এ আইনটিতে দেখা হবে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, সমসাময়িক বিশ্বে সাইবার অপরাধ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত। অনলাইন এবং অফলাইন অপরাধের মধ্যে বিরাট একটা ফারাক রয়েছে। অনলাইনে একটি অপরাধ হলে তার প্রভাব অনেক বেশি প্রচারও বেশি। অফলাইনে সেটা কম। অনলাইনে যে পরিবার বা রাষ্ট্রীয় জীবনে যে ঝুঁকি তা প্রত্যেক রাষ্ট্র অনুভব করছে। এখন একটি রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার জন্য অ্যাটম বোমা হামলার প্রয়োজন নেই। সাইবার আক্রমণ করে একটি পুরো একটি রাষ্ট্রকে ক্ষতিগ্রস্থ করা সম্ভব- সেটা অর্থনৈতিকভাবে এবং প্রশাসনিকভাবে। সে কারণেই এ আইনটি করা হচ্ছে।
যে কারণে ৫৭ ধারা সমালোচিত
তথ্যপ্রযুক্তি আইন, ২০১৩-এর ৫৭ ধারা নিয়ে সারা দেশে বিতর্ক চলছেই। এরই মধ্যে এ আইন বাতিলের নির্দেশনা চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট মামলা বিচারাধীন। সাংবাদিক প্রবীর সিকদারকে আটকের পর থেকেই মূলত এ আইন নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইতে থাকে। কী আছে এ আইনে? এবং কীভাবে অপব্যবহার হতে পারে এ আইনের? এবং কেন এ আইন বাতিলের দাবি উঠেছে, সে বিষয়টি নিচে তুলে ধরা হলো।
তথ্যপ্রযুক্তি আইন তৈরির ইতিহাস
বাংলাদেশে মূলত তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ২০০৬ সালে প্রথম তথ্যপ্রযুক্তি আইন তৈরি করা হয়। ওই আইনে নয়টি অধ্যায়ে মোট ৯০টি ধারা যুক্ত করা হয়। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে ল্যাপটপ, স্মার্টফোনের ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বেড়ে যায়। এ আইনের অপব্যবহার ও ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিষয়টি অনুধাবণ করে সরকার ২০১১ সালে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে সংশোধন আনার চিন্তা শুরু করে। এবং এ আইনের শাস্তি ও আইন প্রয়োগে পরিবর্তন আনার চিন্তা করে। অবশেষে ২০১৩ সালে তথ্যপ্রযুক্তি আইন সংশোধন করে এ আইন প্রণয়ন করা হয়। একই বছরের ৮ অক্টোবর সংসদে আইনটি সংশোধিত আকারে পাস করা হয়।
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় যা রয়েছে
৫৭-এর ১ উপধারায় বলা হয়, ‘কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ।’
অপরাধের শাস্তি
৫৭ ধারার ২ নম্বর উপধারায় বলা হয়, ‘কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১)-এর অধীন অপরাধ করিলে তিনি অনধিক চৌদ্দ বছর এবং ন্যূনতম সাত বৎসর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’
আইনের ৫৭ ধারার সমালোচনা
তথ্যপ্রযুক্তি আইনটি সংশোধন করে ২০১৩ সালে জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার পর থেকে সমোলাচনা শুরু হয়। কেননা, এ আইনে পুলিশকে সরাসরি মামলা করার ও পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। মানবাধিকারকর্মী ও সংবাদকর্মী ছাড়াও অনলাইন ব্যবহারকারীদের অনেকেই মনে করছেন, এ আইনের অপব্যবহার হতে পারে। তাদের শঙ্কার কথা অবশ্য এরই মধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে।
আইনজীবীর চোখে ৫৭ ধারার বিশ্লেষণ
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া আইনটির বিশ্লেষণ করে এর অপব্যবহার সম্পর্কে বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বিশ্লেষণ করলে সাতটি বড় ধরনের অস্পষ্টতা দেখা যায়। তা হলো, মিথ্যা ও অশ্লীল, নীতিভ্রষ্টতা, মানহানি, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি।’ ব্যারিস্টার বড়ুয়া আরো বলেন, ‘ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচারের কথা বলা হচ্ছে, যা হবে মিথ্যা বা অশ্লীল। কিন্তু সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নীতি বা নৈতিকতার কথা বলা থাকলেও কোন কোন বিষয়বস্তুকে অশ্লীল বা মিথ্যা হিসেবে আখ্যায়িত করা হবে, তা এই ধারায় সুস্পষ্ট করা হয়নি। এ ক্ষেত্রে এ আইনটি সুনির্দিষ্টতার অভাবের কারণে দুষ্ট। এ কারণেই এ আইনের অপ্রয়োগের অনেক বেশি সুযোগ রয়েছে।’
ব্যারিস্টার বড়ুয়া সাংবাদিক প্রবীর সিকদারের আটকের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘নিরাপত্তা না পেয়ে যিনি ফেসবুকে অসহায়ত্ব প্রকাশ করলেন, তাঁকে নিরাপত্তা না দিয়ে উল্টো অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দেওয়া মামলায় আটক করা অস্বাভাবিক। এখানেও আইনের অপপ্রয়োগ স্পষ্ট।’ ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া মনে করেন, ‘সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা সাংঘর্ষিক। এই ধারাটি সংবাদপত্র ও নাগরিকের স্বাধীনতাকে খর্ব করছে, যা সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। ৩৯ অনুচ্ছেদে দেশের সব নাগরিকের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কতিপয় শর্ত সাপেক্ষে নাগরিকের বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে।’
বড়ুয়া আরো বলেন, ‘৫৭ ধারা যদি প্রচলিত থাকে, তাহলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অপব্যবহার করে অপছন্দের যে কাউকে দমন-পীড়ন চালানো যাবে। এমনিতেই মানুষ আতঙ্কে রয়েছে। আর এই আতঙ্ক থাকলে আর যাই হোক, চিন্তার স্বাধী���তা থাকে না।’
এ আইন বাতিল প্রসঙ্গে সরকারের মনোভাব
আইনটি নিয়ে সরকারের মধ্যেও মতবিরোধ রয়েছে। সম্প্রতি আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, আইনটি বাতিলের দাবি বিবেচনা করে দেখা হবে। এ ছাড়া তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, এ আইন বাতিল বা সংশোধনে জাতীয়ভাবে আলোচনা হতে পারে। সবশেষে আজ রোববার আইনটির বিষয়ে একটি সম্ভাব্য বিবেচনার কথা বলেছেন আইনমন্ত্রী। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন-২০১৬ (ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন) পাস হলে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬ ও ৫৭ ধারা বাদ দেওয়া হবে।