বেগম খালেদা জিয়া (১৯৪৫–২০২৫): গণতন্ত্র, মর্যাদা ও জাতীয় ঐক্যের অবিনাশী প্রতীক
আজ ভোর ৬টায় ঢাকার এভারকেয়ার হসপিটালে বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অনন্য রাষ্ট্রনায়ক দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া চিরবিদায় নিলেন। তার প্রয়াণে জাতি হারাল গণতন্ত্রের এক দৃঢ় কণ্ঠ, আর মানবিক উন্নয়নের এক দূরদর্শী স্থপতিকে।
বেগম জিয়ার রাজনৈতিক জীবন সংগ্রামের আগুনে গড়া। আশির দশকে স্বৈরশাসক হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের অগ্রভাগে দাঁড়িয়ে তিনি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পথে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। পরবর্তী দেড় দশকে যখন আবারও গণতান্ত্রিক পরিসর সংকুচিত হয়, তখন তিনি নির্যাতন, কারাবরণ ও অসুস্থতার মধ্যেও আপসহীন থেকে কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে ওঠেন। বিশেষত শেখ হাসিনার শাসনামলে। ব্যক্তিগত ত্যাগকে তিনি রূপ দিয়েছিলেন জাতীয় সংগ্রামে।
তার নেতৃত্ব কেবল শাসনবিরোধী আন্দোলনে সীমাবদ্ধ ছিল না; তা জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিও মজবুত করেছে। রাজনৈতিক মতভেদ, ধর্ম, বর্ণ, সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে বহু নাগরিক তাকে দেখেছেন সংবিধান, ন্যায় ও মর্যাদার প্রতীক হিসেবে। তীব্র মেরুকরণের সময়েও তার অবস্থান অনেকের কাছে আস্থার আশ্রয় ছিল।
রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার উন্নয়নচিন্তা ছিল সময়ের চেয়ে এগিয়ে। স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও শিক্ষাকে তিনি জাতীয় অগ্রাধিকারে স্থান দেন। যখন মানব উন্নয়ন এখনো মূলধারার নীতিতে যথেষ্ট গুরুত্ব পায়নি। তার সরকারের প্রবর্তিত খাদ্য বা নগদ অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচি একটি নীরব বিপ্লব ঘটায়: মেয়েদের স্কুলে ভর্তি ও উপস্থিতি বাড়ে, নারীদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়, এবং শিক্ষার ক্ষমতায়নে প্রজননহার কমে। এই উদ্যোগ কেবল সূচক বদলায়নি— কোটি কোটি নারীর জীবনে মর্যাদা ও উৎপাদনশীলতার নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এই মডেল স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশে শিক্ষাবৃত্তি ও প্রণোদনাভিত্তিক এই উদ্যোগ বহু বৈশ্বিক ফোরামে উপস্থাপিত হয় এবং নাইজেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে অনুরূপ কর্মসূচি গ্রহণে অনুপ্রেরণা জোগায়, যার লক্ষ্য ছিল নারীদের শিক্ষা ও ক্ষমতায়ন। এতে স্পষ্ট হয় বেগম জিয়ার নীতির মৌলিক শক্তি: অন্তর্ভুক্তিমূলক, বাস্তবসম্মত এবং সামাজিক ন্যায়ভিত্তিক উন্নয়ন।
আজ শোকের এ দিনে বাংলাদেশ স্মরণ করে বেগম খালেদা জিয়াকে। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয় কেবল; বরং বিভক্ত সময়ে ঐক্যের প্রতীক, ভয়ের সময়ে গণতন্ত্রের রক্ষাকর্তা, আর মানবিক উন্নয়নের দূরদর্শী নীতিনির্ধারক হিসেবে। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন গণতন্ত্র কোনো স্লোগান নয়; এটি সাহস, সহমর্মিতা ও দৃঢ়তার ধারাবাহিক চর্চা।