৭১ থেকে ২৪: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির যোগ–বিয়োগ
লম্বা একটা সময় গেছে, যখন ইতিহাসের নির্মোহ বিশ্লেষণ রীতিমতো একটা দুঃসাহসী কাজ হয়ে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরে যে বিরাট রাজনৈতিক ইন্দ্রজাল গড়ে তুলেছিল আওয়ামী লীগ, তার আড়াল থেকে ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া মানুষগুলোর ভালো-মন্দ বিচার করা হয়ে উঠেছিল প্রায় অসম্ভব।
এর মধ্যেও কেউ কেউ শত ভয়ভীতি, বাধা উপেক্ষা করে ইতিহাসের সত্যটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন, তুলে ধরার চেষ্টা করে গেছেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। তাঁদের চোখে মুক্তিযুদ্ধ এবং এর পরের বছরগুলো দেখার সুযোগ হয়েছে।
অন্যদিকে চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান দেখার, জানার আর কিঞ্চিৎ বোঝার সুযোগ হয়েছে নিজের চোখেই। এই দুই দেখার মিল-অমিলের হিসাব মেলাতে বসেছি ২০২৬ সাল আগমনের আগে।
২.
২০২৪-এর পর জুলাই অভ্যুত্থান দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে ঢেকে দেওয়ার প্রয়াস যেমন চোখে পড়েছে, তেমনি শেখ মুজিবকে পুরোপুরি খারিজ করার চেষ্টাও হয়েছে। কিন্তু কোনো এক পক্ষের ইতিহাসের বয়ান দিয়ে সমগ্র জাতি ইতিহাসের দায় থেকে মুক্তি পায় না।
রাজনীতির রঙে ইতিহাসকে পুনর্লিখন করতে থাকলে, দায়দেনা বুঝে নিতে ইতিহাস তার পুনরাবৃত্তি ঘটায়। তাই একদেশদর্শী ইতিহাসের ঘূর্ণাবর্ত থেকে বেরিয়ে আসার এ সুযোগ কাজে লাগানো প্রয়োজন।
১৯৭১ পর্যন্ত কালপর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে খুব বেশি প্রশ্নের অবকাশ নেই। প্রশ্নের সূত্রপাত বোধ করি তিনি ২৫ মার্চ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন কি না, তা নিয়ে। কিংবা কেন তিনি তাজউদ্দীন আহমদের অনুরোধ উপেক্ষা করে স্বেচ্ছায় গ্রেপ্তার হলেন?
তবে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগ সম্পর্কে সে সময় থেকেই প্রশ্ন তোলার অবকাশ আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বামপন্থীদের যুদ্ধ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা কেন করা হলো? কেন মুক্তিযুদ্ধের মধ্যেও বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধারা আওয়ামী লীগের হাতে হত্যার শিকার হলেন?
এসব প্রশ্নের উত্তর আছে ক্ষমতার হিস্যা বুঝে নেওয়ার মধ্যে।
৩.
স্পষ্টতই, মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের দখল নেওয়ার
লড়াই শুরু করেছিল আওয়ামী লীগ। সে লক্ষ্যে ভারতের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের খুন করতেও তারা পিছপা হয়নি।
অভিযোগ আছে, ছাত্রলীগের কর্মীদের নিয়ে মুজিব বাহিনী গঠন করাই হয়েছিল বামপন্থীদের নিকেশ করার জন্য। সে কাজ পূর্ণতা পায়
স্বাধীন দেশে সব রাজনৈতিক শক্তিকে সঙ্গে না নিয়ে, কেবল আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে।
এমনকি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া তাজউদ্দীনকেও ছুড়ে ফেলতে বঙ্গবন্ধুর খুব বেশি সময় লাগেনি। তাজউদ্দীন আহমদের আক্ষেপ ছিল, ৯ মাস কীভাবে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, সে কথা জানতেও চাননি শেখ মুজিব।
মুক্তিযুদ্ধের আগপর্যন্ত যে মাওলানা ভাসানী সমানতালে লড়েছেন মুক্তির জন্য, তাঁকেও রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক করা হয়েছে খুব দ্রুতই।
এই ভিন্নমতকে কোণঠাসা করার রাজনীতির ফলে জন্ম হয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ)। তাদের অস্ত্রের জোরে দমিয়ে রাখার প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়েছে গণবাহিনীর।
প্রায় গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে ঠেকেছিল সদ্য স্বাধীন দেশটি। রক্ষীবাহিনীর হাতে হত্যা আর নির্যাতনের মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল।
বিরামহীন লুটপাটের পিছু পিছু দেশে এসেছে দুর্ভিক্ষ। এক দলের শাসন কায়েম করেও শেষ রক্ষা হয়নি বঙ্গবন্ধুর। নিহত হয়েছেন সপরিবার।
’৭০-এর দশকটাই কেটে গেছে রক্তের হোলিখেলায়। মুক্তিযুদ্ধের সেনানায়কেরা একের পর এক নিহত হয়েছেন। খালেদ মোশাররফ নিহত হলেন ৭ নভেম্বর। কর্নেল তাহেরের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ক্ষমতায় এলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনি ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতে বছর না ঘুরতেই প্রশ্নবিদ্ধ বিচারে ফাঁসি হলো কর্নেল তাহেরের।
জেনারেল জিয়া নিজেও শহীদ হলেন আরেক সেক্টর কমান্ডার জেনারেল মঞ্জুরের মদদে। সেই জেনারেল মঞ্জুর নিহত হলেন পাকিস্তানফেরত জেনারেল এরশাদের ষড়যন্ত্রে।
শেষ পর্যন্ত দেশ স্বাধীন করতে যাঁরা সম্মুখসমরে লড়াই করলেন, সবাই একে অন্যের হাতে বামদদে নিহত হলেন। ক্ষমতায় স্থায়ী হলেন মুক্তিযুদ্ধের ধারেকাছেও না থাকা স্বৈরশাসক এরশাদ।
৪.
মুক্তিযুদ্ধের পর ২০২৪-এর আগে এত রক্তক্ষয় বাংলাদেশে আর হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার
যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, তা পাকিস্তানি হানাদার আর তাদের দোসরদের গণহত্যাকে মনে করিয়ে দিয়েছে।
’৭১-এর মতোই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আবারও একজোট হয়েছে এ দেশের মানুষ। সব মত আর পথের মানুষ একজোট হয়েছিল বলেই স্বৈরাচারের বিদায় সম্ভব হয়েছে।
জুলাইয়ের অভ্যুত্থান মুক্তিযুদ্ধের মতো ৯ মাস স্থায়ী হয়নি। তাই বোধ করি এত অল্প সময়ের মধ্যে অভ্যুত্থানের পর কে ক্ষমতা কুক্ষিগত করবেন, তা ভাবার ফুরসত মেলেনি।
অভ্যুত্থানের ঠিক পরই হঠাৎ সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ অর্থাৎ বন্যা একজোট থাকার প্রয়োজনের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। তাই সে লড়াইও করা গেছে একসঙ্গে।
এরপরও ২০২৪-এর বাকিটা জুড়ে ভারতের তরফে মিথ্যা প্রচার এবং নানা অজানা আশঙ্কা ছেয়ে ছিল। তাই নিজেদের মধ্যে কুৎসিত লড়াইয়ের যে চড়া মূল্য দেওয়া লাগবে, সেটা মনে পড়েছে বারবার।