হাদির জানাজায় নিযুত প্রাণের একাত্মতা
কিছু মৃত্যু মানুষের জীবনাবসান ঘটালেও তা হয়ে ওঠে একটি সময়, একটি চেতনা ও একটি জাতির সম্মিলিত অনুভবের প্রতীক। গত ২০ ডিসেম্বর, ২০২৫ ঢাকায় মরহুম শরীফ ওসমান বিন হাদির জানাজায় নিযুত মানুষের উপস্থিতি তেমনই এক গভীর বার্তা বহন করে যেখানে শোক ব্যক্তিগত ছিল না। পরিবার সতীর্থদের কান্না হয়ে উঠেছিল জাতীয় প্রত্যয় এবং যেখানে বিভক্ত সমাজও এক মুহূর্তের জন্য হলেও এক কাতারে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করেছিল তার আত্মার মাগফেরতের জন্য।
ওসমান হাদি ছিলেন মাঠে-ঘাটে, মঞ্চে-আন্দোলনে, মানুষের সুখ-দুঃখে মিশে থাকা এক সংগ্রামী তরুণ মুখ। তাঁর জীবন ছিল স্পষ্ট উচ্চারণে ভরা। ন্যায়, প্রতিবাদ ও মানবিকতার পক্ষে। তাই তাঁর জানাজায় মানুষের ঢল কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। এটি ছিল ভালোবাসা ও সম্মানের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ।
দেশের বর্তমান বাস্তবতায় আমরা প্রায়ই দেখি মতাদর্শিক বিভাজন, রাজনৈতিক মেরুকরণ ও সামাজিক দূরত্ব। কিন্তু ওসমান হাদির জানাজায় সেই চেনা বিভাজনের রেখাগুলো যেন মুহূর্তের জন্য হলেও মুছে গিয়েছিল। ভিন্ন মতের মানুষ, ভিন্ন পেশা ও বয়সের নাগরিক। সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়ে দোয়া করেছেন। এই দৃশ্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সংকট ও শোকের মুহূর্তে জাতি এখনো এক হতে পারে, যদি উপলক্ষটি হয় সত্যিকারের মানুষের জন্য।
কিছুদিন পূর্বে ওসমান হাদি এক সভায় বলেছিলেন গণভোটের কথা। গত ২০ ডিসেম্বর, ২০২৫ ঢাকায় ওসমান হাদির জানাজা ছিল একটি নীরব গণভোট। তার জানাজায় মানুষের যে অভূতপূর্ব উপস্থিতি দেখা গেছে, তা তেমনই এক নীরব অথচ উচ্চকণ্ঠ বার্তা বহন করে। তেমন কোনো মাইক ছিল না, কোনো ব্যানার বা পোস্টারও ছিল না। তবু সেই জানাজা ছিল একটি নীরব গণভোট, যেখানে মানুষ তাদের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে নিঃশব্দ সম্মতিতে।
তাই সংসদের দক্ষিণ প্লাজার ওসমান হাদির শেষসভা অর্থাৎ, এ জানাজা ছিল নীরব অথচ প্রতিবাদী এক গণজমায়েত। যেখানে মানুষ মতামত দিয়েছে চরিত্রের পক্ষে, সাহসের পক্ষে, নৈতিক অবস্থানের পক্ষে। ওসমান হাদি হয়তো রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন না, কিন্তু মানুষের হৃদয়ে তিনি যে জায়গা করে নিয়েছিলেন, তা তাঁর জানাজার ভিড়েই স্পষ্ট। এটি প্রমাণ করে, জনপ্রিয়তা কেনা যায় না; তা অর্জন করতে হয় দীর্ঘদিনের সততা ও ত্যাগের মাধ্যমে।
একই সঙ্গে এই নীরব গণভোট একটি অস্বস্তিকর প্রশ্নও তোলে। জীবদ্দশায় ওসমান হাদির কণ্ঠ কতটা গুরুত্ব পেয়েছে? তাঁর মতো মানুষদের কি আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছি, নাকি মৃত্যুর পরই তাদের মূল্য বুঝতে শিখি? যদি জীবিত অবস্থায়ই তাঁর কথা শোনা হতো, তবে কি আজ এই জানাজা অন্যরকম হতো?
এই গণজমায়েত আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্বের জন্যও একটি শিক্ষা। জনগণ কেবল স্লোগান বা প্রতিশ্রুতি নয়, তারা খোঁজে বিশ্বাসযোগ্যতা। যারা জীবদ্দশায় মানুষের পাশে দাঁড়ান, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেন এবং ভয়কে অগ্রাহ্য করে নৈতিক অবস্থান নেন, মৃত্যুর পর মানুষ তাদের একা পরপারে যেতে দেয় না। প্রাণভরা দোয়া দিয়ে ঝুলি ভরে দেয়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- জানাজা
- একাত্মতা
- শরিফ ওসমান হাদি