মোটরসাইকেল আস্তে চালাও, জীবনের গতি বাড়াও
মোটরসাইকেল চালানো শুধু গতির আনন্দ নয়, তরুণদের কাছে এটি স্বাধীনতার প্রতীক, জীবনের প্রথম ডানায় ভর করে উড়ার অনুভূতি। কিন্তু কখনও কখনও এই স্বাধীনতাই জীবনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হয়ে ওঠে, যখন গতি বুদ্ধিকে ছাড়িয়ে যায়। আমরা প্রায়ই দেখি শহরের রাস্তায় বা হাইওয়েতে তরুণরা দ্রুতগতিতে বাইক ছুটিয়ে বেড়াচ্ছে, হর্ন বাজিয়ে অনায়াসে লেন কাটছে, কখনও স্টান্ট করছে। তাই বলছি—মোটরসাইকেল আস্তে চালাও, জীবনের গতি বাড়াও। কারণ বাইকে দ্রুতগতি হয়তো কয়েক সেকেন্ডের উত্তেজনা দেয়, কিন্তু একটি দুর্ঘটনা পুরো জীবন থামিয়ে দিতে পারে। তাড়াহুড়োর রাস্তায় গতিই সর্বনাশা, কিন্তু নিয়ন্ত্রিত গতিই নিরাপদ ভবিষ্যতের চাবিকাঠি।
বাংলাদেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ভয়াবহ হারে বাড়ছে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির তথ্য অনুযায়ী, আমাদের দেশে মোট সড়ক দুর্ঘটনার প্রায় ৪০ শতাংশে মোটরসাইকেল জড়িত। শুধু ২০২২ সালেই ৩,৮৮০ জন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছে—যার বড় অংশ ১৬ থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণ। এটা কেবল একটি সংখ্যা নয়, প্রতিটি সংখ্যার পেছনে রয়েছে একটি পরিবার, একটি অপূর্ণ স্বপ্ন, একটি নিভে যাওয়া হাসি। কারও বাবা ফিরল না বাড়ি, কারও ভাই হাসপাতালের বেডে পড়ে রইলো মাসের পর মাস, কারও বন্ধুর প্রিয় হাসি আর ফিরে আসেনি। কেউ হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, কেউ নতুন চাকরি পেয়েছে, কেউ স্টার্ট-আপ শুরু করতে যাচ্ছিল—কিন্তু একটি দ্রুতগতির ভুল সবকিছু থামিয়ে দিলো। ভাবুন, একটি লাইট সিগন্যাল অমান্য করা, একটি ওভারটেকের ভুল, একটি হেলমেট না পরা—কত বড় বিপদ ডেকে আনে।
বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বলছে, বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ১.৩ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়, যার ২৮ শতাংশ মোটরসাইকেল চালক। ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ভারতসহ অনেক দেশে মোটরবাইকের ব্যবহার বেশি হওয়ায় দুর্ঘটনার হারও বেশি। তবে এসব দেশেই সচেতনতা ও নিরাপত্তা-ব্যবস্থা বৃদ্ধি পাওয়ায় মৃত্যুহার কমে এসেছে। থাইল্যান্ডে বাধ্যতামূলক হেলমেট আইন কার্যকর হওয়ার পর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যু ২৩ শতাংশ কমেছে। মাটিতে গতি কমিয়ে মানুষ বরং জীবনে গতি পেয়েছে। আমাদের দেশও পারে—যদি তরুণরা নিজের সুরক্ষাকে সম্মান করে, জীবনের মূল্য বোঝে।
তরুণ বয়সে উদ্দীপনা স্বাভাবিক। এই সময় আমরা ভাবি, “আমি পারব”, “আমার কিছু হবে না”, “এই লাফটা দিই না”—কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, দুর্ঘটনা কখনো অনুমতি নিয়ে আসে না। জানা কথা আছে—“Speed thrills but kills.” আবার আরেকটি গভীর উক্তি—“A helmet may look boring, but it’s far better than a wheelchair.” আমাদের অনেকেই মনে করি হেলমেট শুধু পুলিশের চোখ ফাঁকি দেওয়ার জন্য মাথায় রাখা, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হেলমেট জীবনরক্ষার ঢাল। গবেষণায় দেখা গেছে, হেলমেট দুর্ঘটনায় মৃত্যুঝুঁকি ৪২ শতাংশ এবং মাথায় আঘাতের ঝুঁকি ৬৯ শতাংশ কমায়। তবুও আমরা হেলমেট না পরে বের হই, অথবা আধা-হেলমেট ব্যবহার করি যা বিপদের সময় কোনো লাভ দেয় না। জীবন যখন একটিই, কেন সামান্য অবহেলায় তা ঝুঁকিতে ফেলব?
রাস্তায় বাইক চালানো শুধুই যন্ত্র চালানো নয়, এটি একটি দায়িত্ব। নিজের প্রতি দায়িত্ব, পরিবারের প্রতি দায়িত্ব, সমাজের প্রতি দায়িত্ব। যখন আমরা দ্রুত বাইক চালাই, রাস্তার অন্যান্য মানুষের জীবনও ঝুঁকিতে ফেলি। তোমার মা তোমার অপেক্ষায় রান্না করে বসে আছে, বাবা হয়তো দরজায় কান পেতে দাঁড়িয়ে আছে, ছোট বোন জানালায় তাকিয়ে আশা করছে তুমি ফিরবে। তুমি যদি একটি ছোট ভুলের কারণে ফিরে না আসো, তাদের সেই অপেক্ষা চিরদিনের হয়ে যাবে। স্টান্টের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হতে পারে, কিন্তু হাসপাতালের বেডে জীবন আটকে গেলে সেই ভিডিও দিয়ে বাঁচা যায় না। একজন রাইডারের ঠিক পাশে বসে থাকা বন্ধু হয়তো ভাবছে দ্রুতগতি কুল লাগে, কিন্তু যখন ব্রেক ঠিকমতো কাজ করল না, তখন সেই বন্ধুই হতে পারে সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত।
কিন্তু গল্পের অন্য দিকও আছে—হাজারো তরুণ প্রতিদিন নিরাপদে বাইক চালায়, নিয়ম মেনে চলে, হেলমেট পরে, সিগন্যাল মানে, অতিরিক্ত গতি নেয় না। তারা সময়মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে, অফিসে যায়, পরিবারকে সময় দেয়, জীবনের লক্ষ্য পূরণের পথে এগিয়ে যায়। তারা জানে—ধীরে চালালে কেবল বাইক নয়, জীবনও টেকসই হয়। একজন সফল উদ্যোক্তা বা পেশাজীবী হতে চাইলে শৃঙ্খলা প্রয়োজন, আর শৃঙ্খলিত রাইডিং সেই শৃঙ্খলার প্রথম ধাপ। আমরা ভবিষ্যতে যারা দেশ চালাব, নতুন কোম্পানি বানাব, প্রযুক্তি তৈরি করব—তাদের জীবনই তো দেশের সম্পদ। তাহলে জীবনকে তুচ্ছ করে কেন কয়েক সেকেন্ডের উড়ন্ত আনন্দে নিজেকে উৎসর্গ করব?
- ট্যাগ:
- মতামত
- সড়ক দুর্ঘটনা
- মোটরসাইকেল চালক