আমাদের সড়ক ও মহাসড়কগুলো দেশের অর্থনীতি, শিল্প-বাণিজ্য ও যাতায়াতের প্রধান ভিত্তি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সত্য- এসব সড়কের দুপাশ দখল হয়ে যাচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত দোকানপাট, হাট-বাজার, গ্যারেজ, চা-ঢালাই স্টল, এমনকি বসতবাড়ির সম্প্রসারণে। এই দখল শুধু আইন লঙ্ঘনই নয়; এটি সরাসরি জীবনহানির ঝুঁকি তৈরি করছে। মহাসড়কের দুপাশে দোকানপাট গড়ে উঠলে প্রথমত সড়কের দৃশ্যমানতা কমে যায়। হঠাৎ করে দোকানে ঢোকা-বেরোনো মানুষ, ক্রেতার ভিড়, রাস্তার কিনারায় দাঁড়ানো মোটরসাইকেল বা ভ্যান- এসবের কারণে চালকদের মনোযোগ বিচ্যুত হয়। এতে প্রায়শই বড় ধরনের দুর্ঘটনার কথা আমরা শুনি। বিশেষ করে বাজারসংলগ্ন স্থানে গতি কমানো বা সিগন্যাল ব্যবস্থা না থাকায় দুর্ঘটনার হার আরও ব্যাপক হয়।
অনিয়ন্ত্রিত দখলের কারণে মহাসড়কের মূল নকশাও ব্যাহত হয়। রাস্তার কাঁধ সংকুচিত হয়ে পড়ে, জরুরি মুহূর্তে ওভারটেক করা বা দুর্ঘটনার সময় গাড়ি থামানোও কঠিন হয়ে যায়। অনেক সময় দেখা যায়, দোকানের ময়লা-আবর্জনা, নির্মাণসামগ্রী কিংবা পণ্য রাস্তার ওপর পর্যন্ত চলে আসে, যা সড়ককে বিপজ্জনক করে তোলে। এসব দোকানপাটের কারণে মহাসড়ক হয়ে যায় জনসমাগমের জায়গা, যা নিয়মতান্ত্রিক চলাচলের জন্য মারাত্মক প্রতিবন্ধক। স্কুল, বাজার, চায়ের দোকান বা গ্যারেজের সামনে যাত্রী উঠানামার জটলা সৃষ্টি হয়- যা মহাসড়কের গতিশীলতার সঙ্গে একেবারেই অসামঞ্জস্য।
অতি সম্প্রতি ইথিওপিয়া ও কেনিয়ায় ব্যবসা সংক্রান্ত এক কাজে যাওয়ার সুভাগ্য আমার হয়েছিল। সেখানকার সড়ক পথের যোগাযোগ ব্যবস্থার কিছু চিত্র এই লেখায় তুলে ধরছি। এ কথা সত্য যে, দেশ দুটি অর্থনীতির নানান সূচকে আমাদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে থাকলেও যোগাযোগ খাতে দেশ দুটির অগ্রগতি সত্যি অবাক করার মতো।
প্রথমে ইথিওপিয়ার কথা বলছি। বিগত এক দশক ধরে আফ্রিকার অন্যতম বিকাশমান দেশটির অর্থনীতি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশের মতো কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিই ইথিওপিয়ার প্রধান অবলম্বন হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পোশাকশিল্প, টেক্সটাইল, লেদার ইন্ডাস্ট্রি এবং লাইট ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। হাওয়াসা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কসহ কয়েকটি শিল্পাঞ্চল বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করছে। সড়ক, রেল, টেলিকম এবং বিদ্যুতে বড় ধরনের সরকারি বিনিয়োগ অর্থনীতিতে নতুন গতি এনে দিয়েছে। ১১ কোটির বেশি জনসংখ্যা-এর বিশাল অংশ তরুণ- দেশটির অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতার সম্ভাবনা তৈরি করছে। শিল্পের রূপান্তর দেশটির আগামী দিনে লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে বিদেশী বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করতে দেশটির যোগাযোগ ব্যবস্থার অগ্রগতি যে কাউকে অনুপ্রাণিত করবে।
ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবা থেকে প্রায় ২৪০ কিলোমিটার দূরের গাদা (GADA) ইকোনমি পার্ক ও জোন ভিজিটে আমাকে যেতে হয়। বিস্ময়কর হলেও সত্যি, পথিমধ্যে প্রশস্ত রাস্তার দু’পাশে দোকানপাট, অযথা বসতি ও অবৈধ দখলদার চোখে পড়েনি। বরং রাস্তা গতিময়, আধুনিক ও ঝামেলামুক্ত। নেই যানজটের চাপ, নেই ট্রাফিক সিগন্যাল, গাড়ির গতি থাকে স্থির ও নিরাপদ। স্থানে স্থানে রয়েছে পথচারীর জন্য আলাদা ফুটপাত, আলাদা লেন ও স্বাচ্ছন্দ্যময়। ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠেছে পরিকল্পিত স্থাপনায়, রাস্তার আশপাশেও নয়। যে-কোনো দেশের নগর উন্নয়নের চমৎকার উদাহরণ হতে পারে এমন প্রশস্ত, দখলমুক্ত রাস্তা। যেখানে শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা এবং দ্রুত যোগাযোগ একসাথে নিশ্চিত। এমন একটি শৃঙ্খলিত সড়কের স্বপ্ন দেখি আমরা, যেখানে বাংলাদেশের উন্নয়ন নিহিত।
কেনিয়ায় সড়ক অবকাঠামো তুলনামূলকভাবে উন্নত। দেশটির সরকারি হিসেবে, বিটুমিন করা রাস্তার দৈর্ঘ্য বাড়ছে: জাতীয় ও কাউন্টি রাস্তার কিছু অংশ পাকা রয়েছে, কিন্তু বহু রাস্তা এখনও অপরিপূর্ণ বা নির্মাণাধীন। সব রাস্তা নয়, কিছু মহাসড়কে (Class A, B, C) নিরাপত্তা মূল্যায়ন শুরু করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সড়ক নিরাপত্তা সংগঠন IRAP-এর মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ সেকশন চিহ্নিত করার কাজ চলছে। এই দুটি প্রসঙ্গ তুলে ধরার মূল কারণ, দেশ দুটোর সড়ক ব্যবস্থাপনা কার্যত সীমিত হলে আমাদের চেয়ে উন্নত। মহাসড়কগুলো সুরক্ষায় দেশ দুটি যথেষ্ট দায়িত্বশীল। আমাদের দেশের মতো সড়কের সরকারি জায়গায় ফুটপাত দখল করে দোকানপাট-গ্যারেজ-কলকারখানা-বস্তি বা বসবাস গড়ে উঠেনি। আইন প্রয়োগ ও নজরদারির কারণে এসবের সুযোগও নেই। ফলে দেশ দুটি তাদের বিনিয়োগ-ব্যবস্থাপনা চারদিকে ছড়িয়ে দিতে সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে।