ত্রিশ লক্ষ শহীদ: বাহুল্য নাকি বাস্তবতা

বিডি নিউজ ২৪ আরিফ রহমান প্রকাশিত: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:৫৩

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। সাম্প্রতিক সময়ে এই বিতর্ক নতুন মাত্রা পেয়েছে যখন বিভিন্ন মহল থেকে মৃতের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমিয়ে ‘মাত্র কয়েক হাজার’ বা ‘কয়েক লাখে’ নামিয়ে আনার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। অথচ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্র, তৎকালীন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন, জনমিতিক পরিসংখ্যান এবং শরণার্থী শিবিরের ভয়াবহ চিত্র ভিন্ন কথা বলে। আজ আমরা আবেগের ঊর্ধ্বে উঠে, কঠোর একাডেমিক দৃষ্টিভঙ্গি, গাণিতিক বিশ্লেষণ এবং তুলনামূলক জেনোসাইড স্টাডিজের আলোকে বোঝার চেষ্টা করব, শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখ এই দাবি কতটা আলঙ্কারিক আর কতটা বাস্তবিক–যা নিয়ে আগেও লিখেছি আমি এবং আবারও লিখতে বাধ্য হচ্ছি।


সংখ্যার রাজনীতি বনাম রক্তের ইতিহাস


বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের সঙ্গে ‘ত্রিশ লাখ’ সংখ্যাটি অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। কিন্তু স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরেও আমাদের এই মৌলিক সংখ্যাটি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিভিন্ন আলোচনায় দাবি করা হচ্ছে, ১৯৭১ সালে নিহতের সংখ্যা ছিল মাত্র দুই হাজার, অনেকে সংখ্যাটা এত কম মনে না করলেও তিন লাখের ওপরে উঠতে রাজি নন। এইসব দাবির পক্ষে যুক্তি হিসেবে কখনো পাকিস্তানি কমিশনের রিপোর্ট, কখনো বা বিদেশি সাংবাদিকদের খণ্ডিত প্রতিবেদনকে সামনে আনা হয়।


‘১৯৭১ সালের যুদ্ধটা নিয়ে সব সময়ই একটু বেশি বাড়াবাড়ি করা হয়। সে সময় এমন বড় কিছুই হয়নি...’—এজাতীয় বয়ান যারা তৈরি করেন, তারা মূলত ইতিহাসের একটি ‘রিভিশনিস্ট‘ বা সংশোধনবাদী ধারা তৈরি করতে চান। তাদের প্রধান যুক্তি নির্মিত হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরে। বলা হয়, তিনি পাকিস্তান থেকে ফিরে বিমানবন্দরে ভুল করে ‘থ্রি লাখ’ বলতে গিয়ে ‘থ্রি মিলিয়ন’ বলে ফেলেছিলেন এবং সেখান থেকেই নাকি এই মিথের জন্ম। কিন্তু ইতিহাস কি আসলেই তাই বলে? নাকি ৩০ লাখের এই পরিসংখ্যানের পেছনে রয়েছে গভীর জনমিতিক ও সামরিক বাস্তবতা?


‘স্লিপ অব টাং’ তত্ত্ব: তথ্য কি বলে?


সমালোচকদের বহুল প্রচলিত তত্ত্ব হলো—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে ফেরার পথে আবেগের বশবর্তী হয়ে বা ইংরেজি জ্ঞানের অভাবে তিন লাখকে তিন মিলিয়ন বলেছিলেন। কিন্তু দালিলিক প্রমাণ এই তত্ত্বকে সরাসরি নাকচ করে দেয়। প্রথমত, তিনি দেশে ফেরার আগেই বিশ্বগণমাধ্যমে ৩০ লাখ বা তার কাছাকাছি সংখ্যার উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৯৭১ সালের মার্চেই পাকিস্তানি জান্তা প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান সদম্ভে ঘোষণা করেছিলেন, ‘‘ওদের ত্রিশ লাখ হত্যা কর, বাকিরা আমাদের থাবার মধ্যে থেকেই নিঃশেষ হবে।’ (রবার্ট পেইন, ম্যাসাকার, ১৯৭৩)। অর্থাৎ, হত্যার টার্গেট বা নির্দেশক সংখ্যাটি পাকিস্তানিরাই নির্ধারণ করে দিয়েছিল।


মাওলানা ভাসানী যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়েই দশ লাখ মানুষ হত্যাকাণ্ডের কথা বলেছিলেন। সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশারফ একাত্তরের সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে কানাডার গ্রানাডা টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দশ লক্ষ মানুষের হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ করেন। কবি আসাদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সময় লিখেছেন বেশ কয়েকটি কবিতা। সেসব কবিতায় বারবার এসেছে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর কথা। আসাদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধ চলকালীন সময়ে লেখা তার ‘রিপোর্ট ১৯৭১’ কবিতায় বলেছিলেন ১০ লাখ গলিত লাশের কথা:


‘জনাব উথান্ট,


জাতিসংঘ ভবনের মেরামত অনিবার্য আজ।


আমাকে দেবেন, গুরু, দয়া করে তার ঠিকাদারী?


বিশ্বাস করুন রক্তমাখা ইটের যোগান


পৃথিবীর সর্বনিম্ন হারে একমাত্র আমি দিতে পারি


যদি চান শিশু ও গলিত খুলি, দেওয়ালে দেওয়ালে শিশুদের রক্তের আল্পনা


প্লিজ, আমাকে কন্ট্রাক্ট দিন।


দশ লক্ষ মৃতদেহ থেকে


দুর্গন্ধের দুর্বোধ্য জবান শিখে রিপোর্ট লিখেছি—পড়, পাঠ কর।’


মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হতো ‘চরমপত্র’। সেই চরমপত্রের শেষ প্রচার দিবস অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বরের কিছু অংশ সরাসরি তুলে দিচ্ছি: ‘...২৫ মার্চ তারিখে সেনাপতি ইয়াহিয়া খান বাঙ্গালিগো বেশুমার মার্ডার করনের অর্ডার দিয়া কি চোটপাট! জেনারেল টিক্কা খান সেই অর্ডার পাইয়া ৩০ লাখ বাঙ্গালির খুন দিয়া গোসল করল। তারপর বঙ্গাল মুলুকের খাল-খন্দক, দরিয়া-পাহাড়, গেরাম-বন্দরের মইদ্দে তৈরি হইল বিচ্ছু...’ (চরমপত্র; পৃ: ৩২৫)।


এবার আসি সংবাদপত্রে। শেখ মুজিবুর রহমানই যদি ভুলটি করে থাকেন তাহলে ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ থেকে ৯ জানুয়ারি, ১৯৭২ পর্যন্ত সংবাদ প্রতিবেদনগুলোতে ত্রিশ লাখ শহীদের কথা কী করে এল? যেমন `দৈনিক পূর্বদেশ’ সম্পাদক তার পত্রিকায় ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর ‘ইয়াহইয়া জান্তার ফাঁসি দাও’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় লেখেন। সেখানে পরিষ্কার লেখা হয়, ‘হানাদার দুশমন বাহিনী বাংলাদেশের প্রায় ৩০ লাখ নিরীহ লোক ও দুশতাধিক বুদ্ধিজীবীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে...’। এরপর রাশিয়ার `প্রাভদা’, ৩ জানুয়ারি, ১৯৭২ ত্রিশ লাখের কথা উল্লেখ করে। `মর্নিং নিউজ’, ৫ জানুয়ারি ১৯৭২ ত্রিশ লাখের কথাই আবার উল্লেখ করে সেই সংখ্যাটা পৃথিবীময় ছড়িয়ে দেয়। ঢাকার পত্রিকা দৈনিক `অবজারভার’ শিরোনাম করে এভাবে, ‘পাক আর্মি কিল্ড ওভার ৩০ লাখ পিপল’, যেটা প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালের ৫ জানুয়ারি, ৪ জানুয়ারি আজাদ পত্রিকাও ‘প্রাভদা’র কথা উল্লেখ করে তাদের সংবাদে। আবার বাংলাদেশের ‘দৈনিক বাংলা’ পত্রিকার ৬ জানুয়ারি, ১৯৭২ ‘জল্লাদের বিচার করতে হবে’ শিরোনামে করা প্রবন্ধ ত্রিশ লাখ শহীদের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। যেটা প্রকাশিত হয় ৮ তারিখের আগে। সবগুলো খবরই শেখ মুজিব দেশে আসার আগে প্রকাশিত হয়েছে।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও