অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে মানবাধিকার নিয়ে প্রত্যাশা কি পূরণ হলো
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছিল। বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, খুন, বেআইনি আটকসহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার। সে সময় মানবাধিকার রক্ষা ও উন্নয়নের জন্য জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠন করা হলেও মানবাধিকার রক্ষায় প্রতিষ্ঠানটির কোনো ভূমিকা ছিল না।
প্রত্যাশা ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটবে, মানবাধিকার কমিশনকেও শক্তিশালী ও কার্যকর করা হবে। বাস্তবতা হলো, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে গুম বন্ধ হলেও বিচারবহির্ভূত হত্যা, কারা হেফাজতে মৃত্যু, মব সহিংসতায় মৃত্যুসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অব্যাহত আছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও অকার্যকর আছে এক বছরের বেশি সময় ধরে।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০২৪–এর নভেম্বরে বিগত সরকারের প্রশ্নবিদ্ধ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানসহ সব সদস্যের পদত্যাগের ঘটনার পর আর মানবাধিকার কমিশন পুনর্গঠন করা হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, যথাযথ সংস্কার করে মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালী করে তারপর নতুন কমিশন গঠন করা হবে। এরপর এক বছরের বেশি সময় পার হলেও গঠন করা হয়নি জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।
অবশ্য এর মধ্যে গত নভেম্বরের শুরুর দিকে জারি হয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ, ২০২৫। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই অধ্যাদেশে মানবাধিকার কমিশনের আগের ত্রুটিবিচ্যুতিগুলো দূর করে আরও শক্তিশালী করা হয়েছে। কমিশনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপরাধ তদন্ত ও সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কাছ থেকে ব্যাখ্যা বা প্রতিবেদন আদায় করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অধ্যাদেশ জারির পর এক মাসের বেশি সময় পার হলেও কোনো মানবাধিকার কমিশন গঠন না করায় সরকারের এসব দাবির বাস্তব কার্যকারিতা যাচাই করার কোনো সুযোগ তৈরি হয়নি।
মানবাধিকার কমিশন অকার্যকর থাকার কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘনবিষয়ক হাজারো অভিযোগ নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। এর মধ্যে রয়েছে হত্যা, ধর্ষণ, পারিবারিক ও নারীর প্রতি সহিংসতা, নিখোঁজ, গুম, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু, বিচারবহির্ভূত হত্যা, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সংখ্যালঘু নির্যাতন ও বিনা বিচারে আটকের অভিযোগ।
২.
এর মধ্যে দেশে একের পর এক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে চলেছে। দেশজুড়ে ভিন্নমতাবলম্বী, প্রান্তিক, সংখ্যালঘু ও নারীদের ওপর হামলা-হয়রানি বেড়েছে, বেড়েছে মব সহিংসতা। একের পর এক মাজারে হামলা, বিভিন্ন মেলা, ওরস, বাউল উৎসব বন্ধ, বাউলদের ওপর হামলা, নাটক ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনীতে বাধা, ধর্ম অবমাননার দায়ে হামলা-মামলা-গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে। এসব থামাতে অন্তর্বর্তী সরকারকে কঠোর হতে দেখা যায়নি, বরং সরকারের দায়িত্বশীল কারও কারও বক্তব্য এসবের প্রতি সমর্থনসূচক বলে সমালোচিত হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর—এই ১১ মাসে মব সহিংসতার শিকার হয়ে ১৮৪ জন নিহত হয়েছেন, যা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। আসকের হিসাবে ২০২১ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৮, ২০২২ সালে ৩৬, ২০২৩ সালে ৫১ এবং ২০২৪ সালে ১২৮।
অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত কিংবা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য হাসিল করতে মব সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব ক্ষেত্রে দায়ী ব্যক্তিদের দ্রুত বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হলে সরকার যে মব সহিংসতার ব্যাপারে কঠোর, সে বিষয়ে মানুষের কাছে একটা বার্তা যেত। কিন্তু দেখা গেছে, আলোচিত কিছু ঘটনায় দায়ীদের কাউকে কাউকে গ্রেপ্তার করা হলেও সার্বিকভাবে মব সহিংসতার জন্য দায়ীদের গ্রেপ্তার ও বিচারে জোরালো তৎপরতা দেখা যায়নি।
২০২৪ সালের আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর ২০২৫—এই ১৩ মাসে ৪৬টি পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ৬৭ জনের মৃত্যুর বিষয়ে প্রথম আলোর সংগৃহীত তথ্য থেকে দেখা যায়, মামলাগুলোতে আসামি গ্রেপ্তারের হার নগণ্য। অনেক ক্ষেত্রে মামলা পর্যন্ত হয়নি বা মামলা হলেও কোনো আসামি গ্রেপ্তার হয়নি। ৪৬টির মধ্যে ৩৬টি ঘটনায় মামলা হয়েছে, ১০টি ঘটনায় কোনো মামলাই হয়নি। যেসব ঘটনায় মামলা হয়েছে, তাতে আসামির সংখ্যা ৯ হাজারের বেশি (অজ্ঞাতনামাসহ)। এর মধ্যে ২৭টি মামলায় ১১৪ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন, অর্থাৎ গ্রেপ্তারের হার ১ দশমিক ২৭ শতাংশ। ৬টি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’–এর প্রতিবেদন অনুসারে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৪ মাসে ৪০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে গুলিতে মারা গেছেন ১৯ জন, নির্যাতনে মারা গেছেন ১৪ জন আর পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে ৭ জনকে। এসব ঘটনায় পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে গুমের তদন্ত ও বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও বিচারবহির্ভূত হত্যা বা ক্রসফায়ার-বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাগুলোর তদন্ত ও বিচারের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।